হাসপাতালে ভর্তি হতে চান চারজন রোগী। কিন্তু শয্যা খালি নেই। তাই দুজনকে ভর্তি নেওয়া হয়। বাকি দুজনকে ফিরে যেতে হয়। ভর্তি হতে না পারাদের একজন মো. সাইদুল। বয়স ৮৫ বছর। নার্স মেপে দেখলেন, তাঁর রক্তে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা নেমেছে ৬৭-তে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থা। তবু সাইদুলকে হাসপাতালে ভর্তি করা যায়নি। বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় গতকাল রোববার সাইদুলের মেয়ে সুফিয়া বেগম এনবি নিউজ প্রতিনিধিকে বলেন, তাঁরা দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবু ভর্তির সুযোগ হয়নি। তবে করোনার নমুনা নিয়েছে।
এই চিত্র উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের। এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ইউনিটে শয্যা ছিল ২০টি, যা তিন দিন আগে ৩০টিতে উন্নীত করা হয়। গত শনিবার শয্যা বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়। তবে ওই দিন বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যেই শয্যাগুলো করোনা রোগীতে ভরে যায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে দেশের আরও কয়েকটি জেলা। সেখানে রোগী বাড়ছে। শনাক্তের হার দাঁড়াচ্ছে জাতীয় গড়ের দুই থেকে চার গুণ। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে বলল, দেশে চলতি জুন মাসে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলা ছাড়া অন্যান্য জেলায়ও করোনার ভারতীয় ধরন বা ডেলটা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সংক্রমণ বেশি থাকা জেলার হাসপাতালে জরুরি রোগী ছাড়া অন্য রোগী ভর্তি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আনুষ্ঠানিক বুলেটিনে গতকাল সংস্থাটির মুখপাত্র ও নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের (এনসিডিসি) পরিচালক মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, চলতি মাসে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি আগের মাসের মতো স্বস্তিকর থাকবে না। সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, সেটি নিয়ে তাঁরা শঙ্কিত। তিনি বলেন, ডেলটা ভেরিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ ঘটছে। এটির সংক্রমণ ক্ষমতা অন্যান্য ধরনের চেয়ে বেশি। সংক্রমণ বেশি হলে মৃত্যুও বেশি হবে।
এদিকে সার্বিকভাবে দেশে করোনায় আক্রান্ত নতুন রোগী, শনাক্তের হার, মৃত্যু-সবই আবার বাড়ছে। গতকাল স্বাস্থ্য বুলেটিনে জানানো হয়, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩৮। মৃতদের বড় অংশই রাজশাহীসহ সীমান্তবর্তী জেলার। সংক্রমণ শনাক্তের হার আবার ১১ শতাংশে উঠেছে, যা ৬-৭ শতাংশে নেমেছিল। চলতি জুন মাসের প্রথম ৬ দিনেই ১০ হাজারের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে।
দেশে চলতি বছরের মার্চ থেকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। গতকাল বিধিনিষেধের মেয়াদ আরও ১০ দিন বাড়িয়ে ১৬ জুন পর্যন্ত নেওয়া হয়।
সীমান্তের জেলাগুলোতে করোনা রোগী যে বাড়ছে, তা দেখা যায় পরীক্ষার ফলাফলে। গতকাল সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহীর দুটি পরীক্ষাগারে নমুনার বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৪১ শতাংশ। এই পরীক্ষাগার দুটিতে আশপাশের জেলার নমুনাও পরীক্ষা হয়। এ ছাড়া যশোরে শনাক্তের হার ছিল প্রায় ২৬ শতাংশ, সাতক্ষীরায় ৩৮ ও খুলনায় ১৬ শতাংশ। গত শনিবারের হিসাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শনাক্তের হার ছিল প্রায় ৪১ শতাংশ।
দেশে প্রায় দেড় বছর ধরে চলা করোনা মহামারিতে দেখা গেছে, নতুন রোগী বাড়তে শুরু করার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুও বাড়তে থাকে।
রোগীর চাপে হিমশিম
সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। অনেক হাসপাতালে শয্যাসংখ্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি থাকছে। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে এসে ভর্তি হচ্ছেন অনেকে। চাহিদা অনুযায়ী রোগীদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) নাদিম সরকার এনবি নিউজকে টেলিফোনে বলেন, সংক্রমণের যে পরিস্থিতি, তাতে এই মুহূর্তে শয্যা বাড়িয়ে ২০০ করা হলেও রোগীতে ভর্তি হয়ে যাবে। কিন্তু ৫০ শয্যার বেশি পরিচালনার সক্ষমতা এই হাসপাতালের নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর ও জেলা হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, সংক্রমণ যখন অনেক বেশি বেড়ে যায়, তখন তা যেকোনো দেশের জন্যই বিরাট চাপ হয়ে দাঁড়ায়। দেশে এখন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ শয্যা করোনা রোগীদের জন্য নিবেদিত। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল পর্যন্ত সেখানে রোগী ভর্তি ছিলেন ১২৫ জন। এর মধ্যে করোনায় আক্রান্ত রোগী ছিলেন ৯৫ জন ও উপসর্গযুক্ত ছিলেন ৩০ জন। হাসপাতালটির আইসিইউতে ১৩ ও এইচডিইউতে ১২ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এই হাসপাতালের মুখপাত্র মেহেদী নেওয়াজ এনবি নিউজকে বলেন, হাসপাতালে করোনার জন্য নিবেদিত ইউনিট করার পর একসঙ্গে ১৩০ জন রোগী ভর্তি এই প্রথম। হাসপাতালে সরঞ্জাম সুবিধা তুলনামূলক কম। করোনা রোগীদের জন্য আরও একটি ইউনিট করতে হবে। চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে। নইলে রোগী সামলানো কঠিন হবে।
নাটোর সদর হাসপাতালে রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৩১টি শয্যায় গতকাল দুপুরে ৩৭ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক পরিতোষ কুমার রায় বলেন, সেখানে বাধ্য হয়ে অন্য ওয়ার্ডে করোনা শনাক্ত হওয়া রোগীদের রাখতে হচ্ছে। কম-বেশি সবাইকে ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করতে হচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার জন্য নিবেদিত ওয়ার্ডে শয্যা রয়েছে ২৩২টি। গতকাল দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিলেন ২৩৫ জন। এটি সর্বোচ্চসংখ্যক করোনা রোগী ভর্তির ঘটনা। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, তাঁরা বিকল্পভাবে শয্যার চেয়ে বেশি কয়েকজন রোগীকে ভর্তি করতে বাধ্য হয়েছেন। দু-এক দিনের মধ্যে করোনা চিকিৎসার জন্য আরেকটি ইউনিট খোলা হবে।
বিধিনিষেধ
সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সীমান্তবর্তী দুটি জেলা সম্পূর্ণ এবং সাতটি জেলায় এলাকাভিত্তিক ‘লকডাউন’ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুটি জেলায় বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরীন এনবি নিউজকে বলেন, সীমান্ত এলাকায় বা ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে, সেসব জেলার হাসপাতালগুলোতে প্রস্তুতির কিছু সমস্যা আছে। সব হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, সংক্রমণ বাড়লে হাসপাতালে ভর্তি করার মতো রোগীও বাড়বে, হাসপাতালে চাপ বাড়বে। তাই সংক্রমণ কমানোর সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও যুক্ত হতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় সংক্রমণ বেশি, সেখানে লকডাউন জোরদার করতে হবে। এসব জেলায় সংক্রমণ শনাক্তের জন্য পরীক্ষা ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্ত ব্যক্তি যাঁদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাঁদের চিহ্নিত করা) কার্যক্রম বাড়াতে হবে। যথাযথভাবে রোগী ব্যবস্থাপনা করতে হবে। না হলে পরিস্থিতি আবার গত মার্চ-এপ্রিলের মতো খারাপ আকার নিতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক পরামর্শক মুজাহেরুল হক এনবি নিউজকে বলেন, যেখানে সংক্রমণ বাড়ছে, সেখানে রোগীদের চিকিৎসায় অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে হবে। অক্সিজেন মাস্ক ও হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা পর্যাপ্ত সংখ্যায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।