পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস ও ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে আগামীকাল রবিবার থেকে স্কুল, কলেজ খুলছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ছুটি থাকলেও শুক্র ও শনিবার বন্ধের দিন হওয়ায় রবিবার খুলতে যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে চলমান তাপপ্রবাহ এবং তীব্র গরমের মধ্যে স্কুলে হাজির থাকা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, তীব্র তাপপ্রবাহে জ্বলছে দেশ। তাপপ্রবাহ থেকে তৈরি হওয়া গরমে শিক্ষার্থীরা স্কুলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। প্রসঙ্গত, গত বছরও তীব্র গরমে স্কুল বন্ধ দেয়া হয়েছিল।সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এর মধ্যে গতকাল চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। শুধু গতকালই নয়, গত তিন দিন ধরে জেলাটিতে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির উপরে বইছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বার্তায় এই তীব্র গরম কমার কোনো আশু সম্ভাবনাও নেই। চলতি মাসের বাকি সময় তাপপ্রবাহ চলমান থাকতে পারে বলে জানাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। তীব্র গরমে জনজীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বলে বিভিন্নভাবে সচেতন করার চেষ্টাও করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এসব ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চলমান বন্ধ আরো বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সবাই। প্রয়োজনে গ্রীষ্মের ছুটি এগিয়ে আনার কথাও বলছেন তারা।
প্রসঙ্গত, পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গেও তীব্র গরমের কারণে গ্রীষ্মকালীন ছুটি এগিয়ে এনে আগামী সোমবার থেকে কার্যকর হচ্ছে। সেখানে গ্রীষ্মের ছুটি আগামী ৫ মে থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ তীব্র গরমে স্কুল বন্ধ থাকবে কিনা সে নিয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) মনীষ চাকমা ভোরের কাগজকে বলেন, এই গরমে স্কুল চালু থাকবে না বন্ধ থাকবে সেই নিয়ে শুক্রবারই একদফা আলোচনা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হলে বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন হয় বা সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেয়, তাপপ্রবাহ নিয়ে মানুষের মধ্যে সেই পরিমাণ সচেতনতা নেই। অথচ তাপপ্রবাহ বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং এতে জীবনের ঝুঁকি আছে। সরাসরি ওটার প্রভাব দেখা যায় না বলে জনগণ উদ্বিগ্ন কম থাকে। এটার প্রভাব কিন্তু আছে। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যে তাপপ্রবাহ বাংলাদেশে চলমান তাতে হিট স্ট্রোকের আশঙ্কাও বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি বা যারা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেশি। এই তীব্র গরমে তাই তাদের সচেতন ও নিরাপদে থাকাটা খুবই জরুরি। প্রচুর পানি পান করা, ঢিলেঢালা পোশাক পরা, বাইরের রোদে বেশি সময় না থেকে ছায়ায় অবস্থান করা, রোদে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে ছাতা ব্যবহার করাসহ নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, অতি উত্তপ্ত এই বিশ্ব আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাদের মতে ২০২৭ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৬ শতাংশ। মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন হচ্ছে এবং চলতি বছরের গ্রীষ্মকালে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা তা থেকেই এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা যাবে। প্রতি বছর বিশ্বের তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলে এবং এক বা দুই দশক ধরে এটা চলতে থাকলে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি মারাত্মক প্রভাব দেখা যাবে। যেমন- দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ থাকা, মারাত্মক ঝড় ও তীব্র দাবানল দেখা যাবে।
বিজ্ঞানীদের এমন আশঙ্কার মধ্যেই বাংলাদেশের জেলাগুলোয় তীব্র গরম পড়েছে। জেলাগুলোর পাশাপাশি ঢাকায়ও ব্যাপক গরম পড়েছে। তাপপ্রবাহের বিষয়ে শহরে সরকারি ঘোষণা না হলেও গরমের তীব্রতায় বেলা ১১টার পর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজ আরো বাড়ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিকাল ৪টার আগে সাধারণের পথে বের না হওয়াই ভালো।
আবহাওয়া অফিস বলছে, সারাদেশে তীব্র গরম এবং তাপপ্রবাহ চলমান থাকলেও তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গা। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই- রোদ আর গরমে। প্রখর রোদে পথঘাট সবকিছুই উত্তপ্ত। সব থেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন খেটে খাওয়া শ্রমিকরা। গতকাল শুক্রবার বিকাল ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ১৭ শতাংশ। যা চলতি মৌসুমে জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে গত বৃহস্পতিবার চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি, গত বুধবার ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি ও মঙ্গলবার ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। যা ছিল সারাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এছাড়া তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে বলেও জানায় সংস্থাটি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং দিনাজপুর, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলাসহ ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে স্কুল খুললে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হবে দেশের স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার কারণে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসি বা ফ্যানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার পাশাপাশি বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি আরো বেশি হবে। এছাড়া ড্রেসকোড মেনে জুতা-মোজা ও ফুলহাতার জামা পরা, গরমে ক্লাস শুরুর আগে পিটিতে অংশগ্রহণের কারণেও কষ্ট বাড়বে। এ অবস্থায় গরমের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ ছুটি দেয়ার দাবি উঠেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সোচ্চার হয়ে উঠেছেন অভিভাবকরা।
এ প্রসঙ্গে রাজধানীর প্রথম সারির একটি স্কুলের একজন অভিভাবক সাইফুল আলম বলেন, সারাদেশে তাপপ্রবাহ চলমান থাকায় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ছুটি দেয়া উচিত। কারণ ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই অসুস্থ হয়ে যাবে। কয়েকজন অভিভাবক জানান, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে প্রভাতি ও দিবা- সবশাখার শিক্ষার্থীদেরই গরমে খুব কষ্ট হবে। জুতা-মোজাসহ স্কুল ড্রেস পরে বিভিন্ন স্থানের বাসা থেকে যানবাহনে বা হেঁটে স্কুলে প্রবেশের আগেই ঘেমে অস্থির হয়ে যাবে শিক্ষার্থীরা।
পরে শিডিউল অনুযায়ী পিটি পর্বে অংশগ্রহণ শেষে ভারী ব্যাগ নিয়ে বহুতল ভবনের সিঁড়ি বেয়ে ক্লাসে পৌঁছাতে তাদের চরম কষ্টের শিকার হতে হয়। হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠানে এসির ব্যবস্থা থাকলেও রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত ফ্যান সুবিধাও নেই। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক আলো-বাতাসও পৌঁছায় না। আবার কোনো কোনো স্কুলের ক্লাসে জানালায় পর্দা না থাকায় সূর্যের তাপে বসেই ক্লাস করতে হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিও বাড়বে। যদিও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জানান, সরকার নির্ধারিত নিয়ম-কানুন এবং নিজস্ব উদ্যোগে তৈরি করা একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী স্কুলগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়। তাই কেউ চাইলেই ইচ্ছামতো ছুটি বা নিয়ম-কানুন শিথিল করতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকারের কোনো নির্দেশনার খবর পাওয়া যায়নি।