এনবি নিউজ : দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর মে মাসের শুরুর দিকেই আরও চাপ আসছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ একসঙ্গে শত কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে।
এর সঙ্গে এলসির অন্যান্য দেনা ও স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ তো আছেই। তখন রিজার্ভ আরও কমে যাবে। এই দফায় রিজার্ভ কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসতে পারে।
গত মঙ্গলবার রিজার্ভ ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ১১৮ কোটি ডলার। ঈদ উপলক্ষ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়লেও রিজার্ভ বাড়েনি। রপ্তানি আয়ও নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। এসব কারণে রিজার্ভের ওপর আরও চাপ বাড়বে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, আগামী জুনের শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ৯৯৬ কোটি ডলারে নেমে আসে, যা দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। একই সময়ে নিট রিজার্ভ নেমে দাঁড়াবে ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারে, যা দিয়ে ২ দশমিক ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। গ্রস রিজার্ভ থেকে ৫৫০ কোটি ডলার বাদ দিয়ে আইএমএফ নিট রিজার্ভের হিসাব করেছে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক নিরাপদ মানদণ্ড অনুযাযী সাধারণ সময়ে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সংকটকালে থাকতে হয় চার মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। খাদ্য আমদানি করলে আরও বেশি থাকতে হয়। বাংলাদেশ খাদ্যও আমদানি করে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের আট মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ ছিল।
সূত্র জানায়, আকুর সদস্য দেশগুলো বাকিতে পণ্য আমদানি রপ্তানি করে প্রতি দুই মাস পর পর দেনা পাওয়া নিষ্পত্তি করে। এর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, ইরান ও মিয়ানমার।
আগে শ্রীলংকা এর সদস্য ছিল। অর্থনৈতিক সংকটে দেনা পরিশোধ করতে না পারায় নিজেদের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এসব দেশে বাংলাদেশে রপ্তানি করে কম, আমদানি করে বেশি। যে কারণে প্রতি কিস্তিতেই বাংলাদেশকে মোটা অঙ্কের অর্থ একসঙ্গে পরিশোধ করতে হয়।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পরিশোধ করা হয়েছিল ১০৯ কোটি ডলার। এর আগে নভেম্বর-ডিসেম্বরে পরিশোধ করা হয়েছিল ১১২ কোটি ডলার। গত মার্চ ও এপ্রিলের দেনা বাবদ আরও বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। কারণ রোজার কারণে গত দুই মাসে পণ্য আমদানি বেড়েছে। মে মাসের পাচ কার্যদিবসের মধ্যেই এ অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
আকুর দেনা পরিশোধের পর প্রতি কিস্তিতে রিজার্ভ কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার বা এক বিলিয়ন ডলার কমে যাচ্ছে। গত মঙ্গলবার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১১৮ কোটি ডলার। এ থেকে আকুর দেনা পরিশোধ করলে রিজার্ভ কমে ৩ হাজার কোটি ডলারের সামান্য ওপরে থাকতে পারে। আগামী মে ও জুনের দেনা শোধ করলে গ্রস রিজার্ভ আইএমএফের হিসাবে ২ হাজার ৯৯৬ কোটি ডলারে নেমে আসবে।
আইএমএফের শর্তের কারণে রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন তহবিলে স্থানান্তর করা অর্থ বাদ দিতে হবে। আগে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮০০ কোটি ডলার। আইএমএফ ওই অর্থ বাদ দিতে বলেছিল। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তহবিলে বরাদ্দ অর্থ কমাচ্ছে। যাতে কম অর্থ রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হয়।
ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার ৭০০ কোটি ডলার থেকে কমিয়ে ৫৫০ কোটি ডলারে নামিয়ে এনেছে। এটি আরও ছোট করা হচ্ছে। এর বিকল্প হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় রপ্তানিকারকদের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন তহবিলের আকারও ছোট করা হচ্ছে। অন্য কয়েকটি তহবিল বাতিল করা হচ্ছে। এভাবে রিজার্ভ থেকে বাদ দেওয়া অর্থ কমাতে চাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ সামান্য বেড়েছে। তবে ঈদের পরে তা আবার কমে যেতে পারে। রপ্তানি আয়ে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এদিকে রপ্তানির আদেশ কমে যাওয়ায় রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি গত অর্থবছরের জুলাই মার্চে কমেছে ৩৫ শতাংশ। একই সময়ের ব্যবধানে আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী এপ্রিল ও মে মাসে আমদানি আরও কমতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। তাদের মতে এপ্রিলে ৪৭৪ কোটি ও মে মাসে ৪৬৭ কোটি ডলারের এলসি খোলা হতে পারে। এর মধ্যে শিল্পের কাঁচামালের আমদানিও কমবে।
মার্চে কাঁচামালের এলসি খোলা হয়েছে ৮৫ কোটি ডলারের। এপ্রিলে তা কমে ৮৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার হতে পারে। মে মাসে আরও কমে ৭১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার হতে পারে। ফলে এর প্রভাবে রফতানি আয়ও কমতে পারে।
রপ্তানি আয় কমলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে গিয়ে রিজার্ভে চাপ বাড়বে। কেননা মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০ শতাংশই আসে রপ্তানি আয় থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ রেমিট্যান্স, বিনিয়োগ ও অনুদান থেকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বাজারের ডলারের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার ঘাটতি কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি গত অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে ৪৫০ কোটি ডলারে নেমেছে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে হওয়ায় রিজার্ভের ওপর চাপ কমছে না।
আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় বাণিজ্য ঘাটতিও কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে বৈদেশিক অনুদান কমেছে ২১ শতাংশ, তবে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই সামান্য বেড়েছে।
তারপরও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। গত অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ২২২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৮০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ওই সময়ের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে ঘাটতি।
এ টি