সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে খুলনার প্রতিটি পাড়া-মহল্লা প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গেছে।
মাসুদ রানা : আর মাত্র একদিন পরই খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে প্রচার ও গণসংযোগের কাজ। এখন কেবল ভোটগ্রহণের অপেক্ষা।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, সোমবার সকাল ৮টা থেকে এই দুই সিটিতে ভোটগ্রহণ শুরু হবে। একটানা চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।
স্থানীয় সরকারের এ দুটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে। সেইসঙ্গে পুরো নির্বাচন ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করবে নির্বাচন কমিশন। কোথাও কোনো অনিয়ম দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শনিবার রাতে দুই সিটিতেই আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে নগরী দুটিতে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।
শেষ দিনের প্রচারে আওয়ামী লীগ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজেদের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ ভোট কিনতে কালো টাকা ছড়ানোর পাশাপাশি ভয়-ভীতির পরিবেশ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন।
তবে সব প্রার্থীই ভোটারদের দলবেঁধে কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।
ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র
খুলনা সিটি করপোরেশনের ৩১টি ওয়ার্ডের আওতায় ভোটকেন্দ্র রয়েছে ২৮৯টি। এগুলোর মধ্যে এবার নির্বাচনে ১৬১টি কেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ১২৮টি কেন্দ্রকে সাধারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে খুলনা মহানগর পুলিশ।
অর্থাৎ, মোট কেন্দ্রের ৫৬ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
মহানগর পুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান ভূঞা জানিয়েছেন, বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে কেন্দ্রগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রেগুলোয় সাধারণের চেয়ে বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকেন।
এবার ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোয় দায়িত্ব পালন করবেন সাতজন করে পুলিশ ও ১২ জন করে আনসার সদস্য। সাধারণ প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য এ সংখ্যা যথাক্রমে সাত ও ১০।
অন্যদিকে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৮৪ শতাংশ কেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে।
বরিশাল পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে মোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১২৬টি। যার মধ্যে ১০৬টি কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভোট গ্রহণের দিন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ২৪ থেকে ২৬ জন ও সাধারণ কেন্দ্রে ২২ থেকে ২৪ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।
নগরীর মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মানুষ ভয়ভীতি নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যাবে না, বরং উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেবে।
সিসিটিভি
রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনায় প্রতিটি ভোটকক্ষে একটি ও কেন্দ্রের সুবিধাজনক স্থানে দুটি করে ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। মোট ২ হাজার ৩১০টি ক্যামেরার আওতায় থাকবে এবারের নির্বাচনের সব কর্মকাণ্ড।
বরিশালেও একইভাবে প্রতিটি ভোটকক্ষে একটি ও কেন্দ্রের প্রবেশ পথে দুটি করে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সে হিসেবে এই নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে থাকছে ১ হাজার ১৪৬টি ক্যামেরা।
স্ট্রাইকিং ফোর্স ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা
স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে খুলনা ও বরিশালে মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি।
এর মধ্যে খুলনার নিরাপত্তা নিশ্চিতে মাঠে রয়েছে ১১ প্লাটুন বিজিবি। দুপুর থেকেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে টহল দিতে শুরু করেছেন বিজিবি সদস্যরা।
এই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন বলেন, “প্রতি প্লাটুনে ২০ জন করে বিজিবি সদস্য রয়েছেন। বিজিবির টহল দলের সঙ্গে থাকবেন ১১ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আগামী চারদিন তারা মাঠে থাকবেন।”
এ ছাড়া নির্বাচনে আরও চার হাজার ৮২০ জন পুলিশ ও তিন হাজার ৪৬৭ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।
সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে থাকবেন ৪৪ জন নির্বাহী হাকিম ও ১০ জন বিচারিক হাকিম।
শনিবার বিকাল থেকেই বরিশালে ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য কাজ শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রুম্পা সিকদার।
তিনি জানান, বিজিবির প্লাটুনগুলো শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত স্টেডিয়াম ও টিটিসিতে অবস্থান করছে। ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে বিজিবির ১৩টি দল স্টাইকিং ফোর্স হিসেবে নগরীতে টহল দিচ্ছে।
বিজিবি ছাড়াও নগরীতে চার হাজার ৪০০ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিযুক্ত করা হয়েছে; যার মধ্যে পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা দুই হাজার ৩০০।
এই নগরেও দায়িত্ব পালন করবেন ৩০ জন নির্বাহী ও ১০ জন বিচারিক হাকিম।
নিষেধাজ্ঞা
দুই সিটিতেই ভোটের আগের ও পরের দিন বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্দেশনা অনুযায়ী, শনিবার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত সিটি করপোরেশন এলাকায় কোনো মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না।
এ ছাড়া রোববার মধ্যরাত থেকে সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত ট্রাক, বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, জিপ গাড়ি, পিক আপ, প্রাইভেট কার ও ইজিবাইক চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
তবে, অনুমতি সাপেক্ষে প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি-বিদেশি পর্যটকের ক্ষেত্রে ওই আইন শিথিল করা হয়েছে। এর বাইরে জরুরি সেবা কাজের সঙ্গে যুক্ত যেমন- অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক ও টেলিযোগাযোগ কাজে ব্যবহৃত যানবাহনের ক্ষেত্রে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না বলে নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
প্রার্থী ও ভোটার সংখ্যা
খুলনায় ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৩ জন এবং নারী ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৬ জন।
এই সিটিতে মেয়র পদে পাঁচজন, সাধারণ ৩১টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১৩৬ জন এবং সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডে ৩৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
অন্যদিকে বরিশালে ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৯ জন এবং নারী ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮০৯ জন।
নির্বাচনে সাতজন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া ৩০টি ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১৯ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ১০টি পদের বিপরীতে ৪২ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন।
দু্ই সিটিতেই নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব পর্যবেক্ষকের পাশাপাশি স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমের কয়েকশ সংবাদকর্মী ভোটের খবর সংগ্রহে উপস্থিত থাকবেন।
এ দুই সিটি নির্বাচন নগরীদুটিতে নানা ঘটনা পরিক্রমার জন্ম দিয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপি যেমন নির্বাচনে আসেনি, তেমন দল থেকে বহিষ্কারের পরেও অনেক মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থী ভোটে আছেন।
খুলনায় বিএনপি বা বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত কেউ মেয়র পদে দায়িত্ব নির্বাচনে না দাঁড়ানোয় পাল্লা ভারী নৌকার মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের।
যদিও বিএনপি সমর্থক ভোটারদের ভোট কোনদিকে যাবে তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
জয়ের ব্যাপারে তালুকদার আব্দুল খালেকের পাশাপাশি সুষ্ঠু ভোট হলে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র পদপ্রার্থী মাওলানা আব্দুল আউয়াল।
তিনি বলেন, “বিএনপির সমর্থকরা সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে মানুষ আমাদের বেছে নেবে।”
আশাবাদ জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির খুলনা জেলা সভাপতি শফিকুল ইসলাম মধুও। ২০১৩ সালে মেয়র পদে নির্বাচন করে মাত্র হাজার তিনেক ভোট পাওয়া এই প্রার্থী বলছেন, “বিএনপি মাঠে না থাকায় তাদের সমর্থকদের একটা অংশ আমাকে ভোট দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি লড়াইয়ে থাকব।”
অন্যদিকে বরিশালের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘টুইস্ট’ হিসেবে এসেছেন আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত।
বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর চাচা হলে খোকন সেরনিয়াবাতের সঙ্গে তাদের পারিবারিক বিরোধ স্পষ্ট। সেই বিরোধের রেশ সমর্থক শিবিরেও বিভক্তি টেনেছে। ফলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের এক করে বর্তমান মেয়র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করাতে দৃশ্যপটে শক্ত অবস্থান নিতে হয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে।
আবার বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী মো. কামরুল আহসান রুপনও জয়ী হবেন বলেই প্রত্যাশা করছেন।
তিনি বলছেন, “বরিশালের মানুষ বিশ্বাস করে একটি বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন হবে। তারা বিশ্বাস করে আমার দল জাতীয়তাবাদী দল সামনে ক্ষমতায় আসবে। সেই বিশ্বাস রেখেই আমাকে ভোট দেবে।”
জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমও। বুঝে-শুনে চিন্তা-ভাবনা করে ভোট দিতে তিনি ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এতসব প্রার্থীর মধ্যে কার প্রত্যাশা পূরণ হবে, কার গলায় উঠবে বিজয়ের মালা, কে হবেন সিটি দুটির নতুন মেয়র; তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে সোমবার রাত অথবা মধ্যরাত পর্যন্ত।
তবে সাধারণ ভোটারদের প্রত্যাশা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের। যার মাধ্যমে তারা আগামী পাঁচ বছরের জন্য বেছে নেবেন নগরভবনের প্রধানকে।
যিনি তাদের জীবনযাপন সহজ করবেন, নাগরিক জীবনের নানা সংকটের সমাধান করবেন এবং সর্বোপরি সিটি করপোরেশনকে কার্যকর করতে ভূমিকা রাখবেন।