এনবি নিউজ : সন্তান জন্ম দিতে এসে কুমিল্লার গৃহবধূ মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় আলোচনায় থাকা ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা সাহাকে উকিল নোটিস পাঠিয়েছে।
ওই ঘটনার জন্য সেন্ট্রাল হাসপাতালকে দায়ী করে তার দেওয়া ‘মানহানিকর’ বক্তব্য সাতদিনের মধ্যে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, তা না হলে ডা. সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মামুনুর রশীদ রাসেল জানান, বুধবার তাদের আইনজীবী মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের মাধ্যমে সংযুক্ত সাহার ঠিকানায় ওই উকিল নোটিস পাঠানো হয়।
আইনজীবী মাজহারুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সকালে এনবি নিউজকে বলেন, “আপনারা জানেন, গত মঙ্গলবার তিনি (সংযুক্ত সাহা) তার বাসায় একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। সেখানে সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে কিছু মানহানিকর বক্তব্য দিয়েছেন। ওই বক্তব্য প্রত্যাহারের জন্য আমরা নোটিস দিয়েছি। সাত দিনের মধ্যে বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হবে।”
ওই নোটিসের বিষয়ে কথা বলতে এনবি নিউজের পক্ষ থেকে ডা. সংযুক্তা সাহাকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মাহবুবা রহমান আঁখি অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান জন্ম দিতে চেয়েছিলেন। সেজন্য সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
প্রসবব্যথা উঠলে গত ৯ জুন মধ্যরাতে আঁখিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যায় তার পরিবার। আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলীর ভাষ্য, প্রসূতিকে ভর্তির সময় চিকিৎসক সংযুক্তা হাসপাতালেই আছেন বলা হলেও আসলে তিনি ছিলেন না।
সেই রাতে ওই চিকিৎসকের সহকারীরা প্রথমে স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করেন। সে সময় জটিলতা তৈরি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুটি ওইদিনই মারা যায়।
সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আঁখিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার দুপুরে কিছু আগে তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় আঁখির স্বামীর করা মামলায় দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেন্ট্রাল হাসপাতালে সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকদের অনলাইনে কোনো ধরনের প্রচারে এসেছে নিষেধাজ্ঞা।
গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহা ওই হাসপাতালে আপাতত কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না বলে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুতে যে সেন্ট্রাল হাসপাতালের অবহেলা ছিল, গত সোমবার তা স্বীকার করে নেন ঢাকার গ্রিনরোডের নামি এ চিকিৎসা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক ডা. এটিএম নজরুল ইসলাম। তবে তিনি প্রথমত সংযুক্তা সাহাকেই দায়ী করেছিলেন।
কী গাফিলতি ছিল, সে প্রশ্নে নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “গাফিলতি ছিল প্রথমত ডা. সংযুক্তা সাহার, তারপর ওটির চিকিৎসকদের। কারণ সে সময় তারা সিনিয়র ডাক্তারদের ডাকেনি।”
পরদিন নিজের পরীবাগের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন ডা. সংযুক্তা সাহা।
তিনি দাবি করেছেন, আঁখিকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তখন তিনি দেশেই ছিলেন না। তাকে ‘না জানিয়ে’ ওই রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। সুতরাং শিশু ও মায়ের মৃত্যুতে তার কোনো দায় ‘ছিল না’।
“যে মানুষটা দেশেই নাই তার নাম করে কেন রোগী ভর্তি করবেন? এটা কার স্বার্থে? আমি যদি অপারেশন না করি,যদি নাই থাকি, তাহলে রোগী ভর্তি করালেন কোন আক্কেলে? এটা অবশ্যই একটা বেআইনি ব্যবস্থা। এ ঘটনার জন্য একমাত্র দায়ী সেন্ট্রাল হাসপাতাল।”
সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ করার জন্য ‘সামাজিক আন্দোলন’ শুরু করেছেন দাবি করে এই চিকিৎসক বলেন, সে কারণে একটা পক্ষ তার বিরুদ্ধে ‘এসব কাজ করছে’।
“ওই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে। আমি সবাইকে আহ্বান জানাব, আপনারা এই অনিয়মের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।”
সংযুক্তা সাহা অভিযোগ করেন, কোনো চিকিৎসকের অধীনে রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে নিজস্ব কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেই। বরং বছরের পর পর ধরে কোনো চিকিৎসকের ‘লিখিত সম্মতি না নিয়েই’ রোগী ভর্তি করা হয়। মাহবুবা রহমান আঁখিকে ভর্তি করার সময়ও তার ‘সম্মতি নেওয়া হয়নি’।
“আঁখিকে ভর্তির সময় আমার উপস্থিতির ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে যে আমি বাংলাদেশে আছি। হাসপাতালের এ ধরনের অসদাচরণ এবং অপরাধমূলক পদক্ষেপ… আমার সুনামকে বেআইনিভাবে পুঁজি করেছে। এটা কিছু আর্থিক লাভের জন্য রোগীকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। হাসপাতাল তাদের অনিয়মের সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য আমাকে সহজ লক্ষ্যে পরিণত করেছে।”
অন্যদিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ বুধবার দাবি করেন, সংযুক্তা সাহার নামে রোগী ভর্তির অভিযোগ ‘ঠিক নয়’।
“উনার নামে কোনো রোগী ভর্তি করা হয়নি। কিন্তু উনার কাছে যে এক্সিস্টিং রোগী ছিল সেগুলো তিনি প্রফেসর সামিনা এবং মিলি ম্যাডামের কাছে অ্যাসাইন করে গেছেন। উনারা রাউন্ড দেবেন ট্রিটমেন্টের কিন্তু সংযুক্তা ম্যাডামের প্রটোকল মেনে। উনার নামে কোনো রোগী ভর্তি হয়েছে কিনা সেটা কাগজই কথা বলবে।”
ব্যবস্থাপক বলেন, কোনো কনসালটেন্ট দেশের বাইরে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ব্যক্তিগতভাবে একটা লিখিত নোটিস দেন। কিন্তু সংযুক্তা সাহা অফিসিয়ালি কাউকে বলে যাননি।
উকিল নোটিসে যা আছে
সংযুক্তা সাহা তার মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে ‘একাধিক মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর’ তথ্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতালের উকিল নোটিসে।
সেখানে বলা হয়েছে, “সংযুক্তা সাহা বলেছেন আঁখি তার রোগী ছিল না, এ বিষয়ে হাসপাতাল মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে। আঁখিকে ভর্তির বিষয়ে হাসপাতাল সংযুক্তা সাহার কোনো সম্মতি নেয়নি, অস্ত্রোপচারের সময় তিনি সেখানে উপস্থিত না থাকলেও কীভাবে তাকে ওই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে- সংযুক্তা সাহার এই বক্তব্যও ভিত্তিহীন।”
সেন্ট্রাল হাসপাতাল বলেছে, “ওই মিথ্যা, বানোয়াট বক্তব্যের কারণে সেন্ট্রাল হাসপাতালের খ্যাতি এবং সুনামের ক্ষতি হয়েছে। এজন্য সেন্ট্রাল হাসপাতাল এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।”
ওই নোটিসের মাধ্যমে সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে করা ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য প্রত্যাহারের পাশাপাশি ভবিষ্যতে ওই কোনো ধরনের ‘মিথ্যা অভিযোগ’ না করতে বলা হয়েছে।
নোটিসে বলা হয়েছে, নোটিস পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে করা ‘মিথ্যা বক্তব্য’ প্রত্যাহার করে একটি বিবৃতি দিতে হবে সংযুক্তা সাহাকে। সেই বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্তা সাহার অফিসিয়াল পেইজে দিতে হবে।
না হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে নোটিসে।