মাসুদ রানা : ভ্রাম্যমাণ দোকান বা ফেরি করে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করতে চায় সরকার। এজন্য ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে জনসমাগমস্থলে (পাবলিক প্লেস) ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনের শাস্তি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
আইনের খসড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে উত্থাপনের আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি কমিটিতে পাঠাতে হয়। এই কমিটির অনুমোদন পেলে তা পাসের জন্য মন্ত্রিসভায় তোলা হয়।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধনে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের করা নতুন খসড়া পর্যালোচনা করে ১০টি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে ওই কমিটি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাহেদা পারভীন বলেন, “সংশোধিত খসড়াটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। খসড়ার উপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ সেসব নিয়ে কাজ করছে।”
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ভ্রাম্যমাণ দোকানে বা ফেরি করে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবেন না। এটি করলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এই অপরাধ করলে জরিমানা দ্বিগুণ হবে।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, পাবলিক প্লেস এবং গণপরিবহনে ধূমপানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই বিধান অমান্য করলে তিনশ টাকা অর্থদণ্ড এবং একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এই অপরাধ করলে দ্বিগুণ হারে দণ্ডিত হবেন।
এটি সংশোধন করে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের সঙ্গে ‘তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না’ এমন বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। এই বিধান অমান্যের সাজা ৩০০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়।
বর্তমান আইনে পাবলিক প্লেস হিসেবে যতগুলো স্থানের উল্লেখ রয়েছে সেগুলো সঙ্গে নতুন কিছু স্থাপনা ও জায়গা যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এরমধ্যে ডায়াগনেস্টিক সেন্টার ভবন, হোটেল, যেকোনো ধরেনের রেস্তোরাঁ, খাবারের দোকান, কফি হাউজ, চায়ের দোকানও রয়েছে।
আগের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল, ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌ-বন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন ও প্ল্যাটফর্ম, বাস টার্নিমাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণী ভবন, হোটেল, যে কোনো ধরেনের রেস্টেুরেন্ট, খাবার দোকান, কফি হাউজ, চায়ের দোকান এবং উল্লিখিত পাবলিক প্লেসগুলোর প্রাঙ্গন, কমিউনিটি সেন্টারসহ যে কোনো ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানস্থল, পাবলিক টয়লেট, শিশু পার্ক, মেলা, পাবলিক পরিবহনে আরোহনের উদ্দেশ্যে যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারিসহ সেবাগ্রহণের জন্য মানুষের সারি অথবা সরকার সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দিয়ে সময় সময় ঘোষিত অন্য যেকোনো বা সকল স্থানকে পাবলিক প্লেস হিসেবে রাখা হয়েছে।
সংশোধিত খসড়ায় পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট ‘ধূমপান এলাকা’ বিলুপ্তের প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ সংক্রান্ত কমিটি বলেছে, ‘ধূমপান এলাকা’ বিলুপ্তির বিষয়ে অধিকতর পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলাধুলার স্থান ও শিশু পার্কের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করা যাবে না। এটি করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এই অপরাধ করলে জরিমানা দ্বিগুণ হবে।
কোনো ব্যক্তি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া ছাড়া তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবেন না। লাইসেন্স ছাড়া তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে দণ্ড দ্বিগুণ হবে।
“ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে নিকোটিনযুক্ত বা নিকোটিন ছাড়া ফ্লেভারযুক্ত পদার্থকে উত্তপ্ত করে ধোঁয়া, বাষ্প বা এরোসল তৈরি করে এবং শ্বাসের সঙ্গে মুখে টেনে গ্রহণ করা হয় এমন ইলেকট্রনিক বা ই-সিগারেট, ই-হুক্কা ও এ ধরনের ডিভাইস পাবলিক প্লেসে ব্যবহার করা যাবে না।”
খসড়ায় ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার, হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্টস বা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রডাক্টস যে নামেই অভিহিত হোক না কেন এসবের উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণণ, বিতরণ, কেনাবেচা ও পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইন অমান্য করে এসব করলে তিন মাসের কারদণ্ড, দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে দ্বিগুণ।
আর কোনো কোম্পানি এসব অপরাধ করলে ওই কোম্পানির মালামাল জব্দ করে কোম্পানির মালিক, ব্যবস্থাপক বা সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিকে ছয় মাসের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে দণ্ড দ্বিগুণ হবে এবং ওই কোম্পানির তামাক উৎপাদন ও বিক্রির লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম যেমন- ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার ব্যবহার করতে পারবেন না। আইন অমান্য করে এসব ব্যবহার করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের সঙ্গে মিষ্টিদ্রব্য, মশলা, রং, সুগন্ধি, আসক্তিমূলক দ্রব্য বা কোনো মিশ্রণ যুক্ত করা যাবে না। এটি করলে ছয় মাসের কারদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে দণ্ডও দ্বিগুণ হবে।
গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রগতির জন্য জ্ঞান- প্রজ্ঞার হেড অব প্রোগ্রাম হাসান শাহরিয়ার বলেন, প্রস্তাবিত খসড়ায় যেসব শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমবে।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার আইনের সংশোধনের উদ্যোগকে যুগযোগযোগী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা চাই সরকার দ্রুত এই আইনটি সংশোধন করে সেটি সংসদ পাস করুক। কারণ এটি যত তাড়াতাড়ি সংশোধন করা হবে, জনগণ তত তাড়াতাড়ি এর সুবিধা পাবে।