আশির দশকে স্বাধীন বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের ভিত্তি গড়ে ওঠে। বর্তমানে কম্পিউটার জানা অক্ষরজ্ঞানের মতোই জরুরি বিষয়। কম্পিউটার না জানলে কেউ টিকে থাকতে পারবে না। এই খাতে লাখ লাখ মানুষ কাজ করছে আজ। কম্পিউটার তথা মোবাইল এখন যেন মানুষের একটা অঙ্গের মতোই হয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সবাইকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হতো। তবু হাল না ছেড়ে অসাধারণ কিছু মানুষ এই খাতে নিজেদের পুরোপুরি বিলিয়ে দিয়েছেন। দিনের পর দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন আজকের এই চিত্রকে বাস্তবে রূপ দিতে। তাদের অক্লান্ত ও নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের ভিত্তি গড়ে উঠেছে, মজবুত হয়েছে। এই মানুষগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের ত্যাগ–তিতিক্ষারই ফসল আজকের স্মার্ট বাংলাদেশ।
আজকের প্রজন্ম দেশের সেরা সেই মানুষগুলোর অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে অবদান রাখা কয়েকজন ব্যক্তি ও তাঁদের উদ্যোগকে সামনে আনার লক্ষ্যে বই লিখছেন জনপ্রিয় লেখক ও সাংবাদিক রাহিতুল ইসলাম। ‘তথ্যপ্রযুক্তির নায়ক’ নামের এই সিরিজের দুটি বই এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কাজ চলমান আরও তিনটির। মোট ১০টি বই প্রকাশিত হবে।
এই সিরিজের প্রথম বই তথ্যপ্রযুক্তির নায়ক এস এম কামাল প্রকাশিত হয় এ বছরের অমর একুশে বইমেলায়। বইটি প্রকাশ করে স্বপ্ন ৭১ প্রকাশনী। বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের মহানায়ক এস এম কামালের দীর্ঘ যাত্রা ও অবদান নিয়ে এ বই।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কম্পিউটার ব্র্যান্ড আইবিএম বাংলাদেশ–এর কান্ট্রি ম্যানেজার ছিলেন এস এম কামাল। তাঁর নেতৃত্বেই আশির দশকে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি বিসিএস প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট তিনি। বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রির শুরুটাই হয় বিসিএস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এস এম কামালের নেতৃত্ব ছাড়া আমাদের দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন গড়ে উঠতে পারত না।
একই প্রকাশনী থেকে দ্বিতীয় বই তথ্যপ্রযুক্তির নায়ক আব্দুল্লাহ এইচ কাফি প্রকাশিত হয় এ বছর মার্চে। আশির দশকের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের সব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থেকেছেন আব্দুল্লাহ এইচ কাফি। কম্পিউটার-প্রযুক্তিকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াসহ এই শিল্পের উন্নয়ন ও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে পরিচিত করে তুলতে তাঁর কার্যকর ভূমিকা অগ্রগণ্য। এই বইয়ে আব্দুল্লাহ এইচ কাফির জীবনের জানা-অজানা নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
লেখক রাহিতুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রোগ্রামার শাহেদা মুস্তাফিজ, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে নিয়ে আরও তিনটি বইয়ের কাজ চলমান।
এখনো আমাদের দেশে প্রোগ্রামিংয়ে নারীরা কম আসেন। সেখানে প্রায় ৫০ বছর আগের চিত্র তো কল্পনাই করা যায় না। হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ছিল দেশে, যারা বিদেশে সফটওয়্যার রপ্তানি করত। কোনো নারী তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করতেন না। সুযোগও ছিল না। দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ানো হতো না। তবু দমে থাকেননি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রোগ্রামার শাহেদা মুস্তাফিজ। নিজ যোগ্যতা ও স্পৃহায় এনসিআর ও লিডসে কাজ করেছেন ২২ বছর। এরপর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন নিজের প্রতিষ্ঠান প্রবিতি সিস্টেমসে। বিদেশে সফটওয়্যার রপ্তানিতে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আজও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে পুরোপুরি সক্রিয় তিনি। ‘তথ্যপ্রযুক্তির নায়ক’ সিরিজের তৃতীয় বই তাঁকে নিয়ে।
বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা। দীর্ঘদিন তিনি বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) পরিচালক ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি মুখে মুখে জটিল গাণিতিক হিসাব সমাধান করতে পারতেন। অনেকে তাঁকে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রাথমিক পরামর্শ দিয়েছিলেন এই মানুষটিই। ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনের সফটওয়্যার রফতানি এবং আইটি সার্ভিস রপ্তানি-সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্কফোর্সেরও একজন সদস্য ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ‘তথ্যপ্রযুক্তির নায়ক’ সিরিজে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে লিখতে গেলে ঘুরেফিরে মোস্তাফা জব্বারের নাম আসবেই। সেটি তার মন্ত্রিত্ব পালনের জন্য নয়। বরং মন্ত্রী হওয়ার আগে–পরেও বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে তাঁর অবদান বিরাট। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার হাত ধরে আমরা ‘বিজয়’ পেয়েছি। অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার বিপ্লবে তিনি থাকবেন একদম সামনের সারিতে। তাই ‘তথ্যপ্রযুক্তির নায়ক’ সিরিজের পঞ্চম নায়ক মোস্তাফা জব্বার।
সিরিজটি নিয়ে লেখক রাহিতুল ইসলাম বলেন, ‘এই সব মানুষের হাত ধরে একটু একটু করে তৈরি হয়েছে আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, এই খাতের ভিত তাঁরা মজবুত করেছেন, অথচ ক্রমশ মলিন হয়ে যাচ্ছে তাঁদের গল্পগুলো। ধীরে ধীরে বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে তাঁদের অবদানের কথা। তাই আমার এই উদ্যোগ।’
তিনি জানান, ‘পাঁচটি বই দ্রুতই একটি প্যাকেজের মাধ্যমে বাজারে আনা হবে। আমি তরুণ প্রজন্মকে জানাতে চাই, কীভাবে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এত দূর এগিয়েছে, কীভাবে আমরা পেয়েছি আজকের স্মার্ট বাংলাদেশ। সিরিজটি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি ঐতিহাসিক দলিল হবে।’
প্রকাশিত বই দুইটি প্রথমা ডটকমসহ দেশের সকল অনলাইন বুকশপ ও বইয়ের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে।