এনবি নিউজ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন বলেছেন, দেশের সমুদ্রাঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেট ও মেরিন জেনেটিক রিসোর্সের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে ২০১২ এবং ২০১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্র সীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তির ফলে বাংলাদেশ এখন এই অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছে। গতকাল বুধবার বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ড. মোমেন এসব কথা বলেন।
এসময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স) রিয়াল এডমিরাল (অবঃ) মো. খুরশেদ আলম উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ তার মূল ভূখ-ের ৮১ শতাংশ পরিমাণ রাষ্ট্রীয় জলসীমা অর্জন করে অর্থাৎ সমুদ্রে মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার জলরাশির জলস্তম্ভ, সমুদ্রতল এবং অন্তমৃত্তিকায় বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অর্জন দেশের মেরিন ও উপকূলীয় অঞ্চলে সকল প্রকার সমুদ্র সম্পদ আহরণ, বাণিজ্যিক জাহাজ, জ্বালানি, পর্যটন ইত্যাদি ঘিরে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নকে বেগবান করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক, বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ পূর্বক সুনির্দিষ্ট ৯টি খাত চিহ্নিত করে এবং সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে “সুনীল অর্থনীতি উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা” প্রণয়ন করে যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদিত হয়েছে। বর্তমানে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীনে ব্লু-ইকোনমি সেল থেকে তা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।”
ড. মোমেন বলেন, “বিগত সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে ‘সুনীল অর্থনীতিতে বাংলাদেশ- ইইউ যৌথ সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সুনীল অর্থনীতি উন্নয়নের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ নিরূপণে মাঠ পর্যায়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। উক্ত সমীক্ষায় পেশাজীবী, মৎস্যজীবী, উপকূলীয় জনগণ, উদ্যোক্তা, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সহ সকল অংশীজনদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর তাতে বিশ্লেষণপূর্বক সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ করা হয়।
তিনি বলেন, এছাড়াও, দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়ার্কশপ এবং সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে নীতিনির্ধারক, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী এবং সুশীল সমাজের সাথে সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নে করণীয় দিকগুলো নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়। উল্লিখিত সমীক্ষা বা স্টাডি হতে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিম্নোক্ত ৯টি খাতের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এগুলো হচ্ছে সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা; সামুদ্রিক মৎস্যচাষ উন্নয়ন; বাণিজ্যিক নৌপরিবহনের উন্নয়ন; সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের বিকাশ সাধন; অফশোর ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সুনীল বায়োটেকনোলজি গবেষণা ও উন্নয়ন; জাহাজ নির্মাণ ও রিসাইক্লিং শিল্প সম্প্রসারণ; স্থিতিশীল জীবিকার জন্য ম্যানগ্রোভের বাস্তসংস্থানগত সেবা; সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ; মেরিন স্পেশিয়াল প্ল্যানিং বাস্তবায়ন।
ড. মোমেন বলেন, এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে, অফশোর জ্বালানি ও সুনীল বায়োটেকনোলজি গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেট ও মেরিন জেনেটিক রিসোর্স বিশেষতঃ ‘সিওয়েড’ এর সম্ভাবনা, উপস্থিতি, প্রকৃতি ও মজুদ নির্ণয়ের জন্য দুটি গবেষণা কার্যক্রম যথাক্রমে যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম বাংলাদেশে সামুদ্রিক সিওয়েড’ থেকে বিশেষ ধরণের গবেষণালব্ধ প্রাপ্তির তথ্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “সুনীল অর্থনীতি উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা”-এর আলোকে ‘সুনীল জৈবপ্রযুক্তি’ খাত উন্নয়নের জন্য রিয়াল এডমিরাল (অবঃ) মো. খুরশেদ আলমের নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট, নেদারল্যান্ডস্ সরকারের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদ অর্থাৎ এমজেআর বলে পরিচিত সমুদ্রের প্রাণিজ ও উদ্ভিদ সংক্রান্ত সকল সম্পদের উপস্থিতি, সার্বিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তথা বাণিজ্যিকীকরণ যাচাইয়ের লক্ষ্যে বিগত ২ বছর যাবৎ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রতিনিধিসহ নেদারল্যান্ডস্ ভিত্তিক গবেষক ২০২০ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় মাঠ পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। উক্ত গবেষণা হতে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকায় (ইইজেড) এমজেআর-এর সার্বিক অবস্থান চিহ্নিত করা (ম্যাপিং), বিবিধ প্রজাতি চিহ্নিত করাসহ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেন। সেই ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ২২০ প্রজাতির সিওয়েড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস ইত্যাদি চিহ্নিত করা হয়।
তিনি জানান, পরবর্তীতে এ সকল প্রজাতির উপর প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি টেস্ট নেদারল্যান্ডসে সম্পন্ন করা হয়। কোভিড-১৯ জনিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গবেষণা কার্যক্রমে সাময়িক বিরতির পর ২০২১ সালে তা পুনরায় শুরু হয়। উক্ত কার্যক্রমে বিশেষ করে বাংলাদেশে সিওয়েড এর সম্ভাবনা ও বাণিজ্যিকীকরণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
শাহরিয়ার আলম বলেন, গবেষণালব্ধ ফলাফলে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে প্রাপ্ত বহু সংখ্যক প্রজাতির সিওয়েড এর মধ্যে কয়েকটি প্রজাতির ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশে প্রাপ্ত নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু সিওয়েড-এর ৫টি শিল্পভিত্তিক প্রয়োগ চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে প্রাপ্ত কিছু প্রজাতির সিওয়েড এ প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে যা ফিস ফিড এর প্রোটিনের উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং ফিস ফিডের জন্য আমদানিকৃত ফিস ওয়েলের বিকল্প হতে পারে, যার বাজার অত্যন্ত ব্যাপক।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত কিছু প্রজাতির সিওয়েডে প্রচুর পরিমাণ ফ্যাটি এসিড রয়েছে যা এ্যানিমেল ফিডের মান বৃদ্ধিতে ও প্রাণির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে এ্যানিমেল ফিডের বিশাল বাজার রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত কিছু প্রজাতির সিওয়েডে প্রচুর পরিমাণ অ্যাগার-অ্যাগার রয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের খাদ্য শিল্পে বর্তমানে অ্যাগার- অ্যাগার আমদানি করে তা প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া, সিওয়েড সরাসরি বা প্রক্রিয়াজাত করে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ খাবারের সাথে গ্রহণ করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের খাদ্য শিল্পসমূহে প্রক্রিয়াজাত সিওয়েড এবং অ্যাগার-অ্যাগার এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
বাংলাদেশের সিওয়েডে প্রচুর ‘জেলিং এজেন্ট’ রয়েছে যা বাল্ক কসমেটিকস ইনগ্রিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের প্রসাধনি শিল্পে বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে আমদানি করে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সিওয়েডে প্রচুর পরিমাণে হাই ভ্যালু কসমেটিকস ইনগ্রিডেন্ট রয়েছে যা স্সিন কেয়ার সামগ্রি সহ বহুবিধ প্রসাধনি সামগ্রি তৈরিতে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সামুদ্রিক সিওয়েড থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও পরিচালনার জন্য হ্যাচারি, ফার্মিং, প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট এবং শিল্পভিত্তিক প্রয়োগ প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সিওয়েডের উৎপাদন পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে অতি সহজেই করা সম্ভব। সিওয়েডের চাষ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। সিওয়েডের চাষ বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগণের জন্য সহজ ও নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকর্মীর সহজ কর্মসংস্থান হতে পারে।
শাহরিয়ার আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনীল অর্থনীতি কার্যক্রম গ্রহণের পর দেশ সরাসরি সমুদ্র সম্পদ থেকে নতুন বাণিজ্যিক সম্পদ আহরণের একটি যুগান্তকারী সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে, আগ্রহী ও যোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশের সিওয়েডের সম্ভাবনাময় বিবিধ খাতে কার্যকরী বিনিয়োগ বা অংশগ্রহণ করানো। উল্লেখ্য, উক্ত কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে যোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট থেকে প্রদান করা হবে।
তিনি বলেন, সরকার প্রত্যাশা করছে, যে সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সিওয়েডকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন তারা তাদের লাভের একটি অংশ বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যবহার করবেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স) রিয়াল এডমিরাল (অবঃ) মো. খুরশেদ আলম বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেট এর উপস্থিতি, অবস্থান, প্রকৃতি ও মজুদ নির্ণয়ের লক্ষ্যে সম্পাদিত ডেস্কটপ স্টাডি তুলে ধরেন।
পিকে/৬ডিসেম্বর, ২০২২