আল জাজিরার বাংলাদেশের সঙ্গে কেন এমন শত্রুতা? বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের কারণেই রাজনৈতিকভাবে আল জাজিরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেয় শুরু থেকেই। গত ১ ফেব্রুয়ারি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া দেখেছি আমরা। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মানদণ্ড নিয়ে। আল জাজিরা নামক গণমাধ্যমটি কি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে? কোন দালিলিক প্রমাণ ছাড়া দুইজন ব্যক্তির কথার উপর একটি রাষ্ট্রকে মাফিয়া স্টেট বলতে পারে কিনা। একটি রাষ্ট্র প্রধানসহ যাদেরকে নিয়ে এই প্রতিবেদন তাঁরা প্রত্যেকেই এক একেকটি প্রতিষ্ঠান। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে টার্গেট করা হয়েছে তা সাংবাদিকতার নৈতিকতার পরিপন্থী। কোন মানুষের কথার উপর কোন গ্রহণযোগ্য প্রমাণ ছাড়া তারা কোন রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন কিনা? এমন নানা প্রশ্ন আমার মাথায়ও ঘুরপাক খাচ্ছে কয়েকদিন।
আমরা আগেও দেখেছি ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল বলেও আল জাজিরা মিথ্যা সংবাদ প্রচার করেছিল। তারা জুরাইন কবরস্থানে রানা প্লাজা ধসে নিহতদের সারি সারি কবরকে দেখিয়ে প্রতিবেদন করেছিল। একটা সংবাদমাধ্যম কতটা মিথ্যুক ও ষড়যন্ত্রী হলে এমন ভিত্তিহীন, বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করতে পারে? তাই যে কারো মনে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে আল জাজিরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নাকি এজেন্ডা বাস্তবায়নকারি সংস্থা ?
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়া, উগ্র মতবাদ ও সহিংসতা উসকে দেয়া, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন এবং সরকার পতনের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে সৌদি আরব, বাহরাইন, আরব আমিরাত, জর্দান, ইরাক, মিসর, আলজেরিয়া, মালয়েশিয়া, সুদান, লিবিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে আল জাজিরাকে নিষিদ্ধ করতে দেখেছি।
আল জাজিরা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি এমন অগ্রহনযোগ্য মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেও বাঙালির আশার বাতিঘর জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও বাঙালির অন্যতম গর্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ জনগণের যে আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট করতে পারবে না বা নড়চড়ও হবে না। এই অর্থে তাদের মিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ও উন্ননবিরোধী একটা গোষ্ঠীর কাছে ভীষণ আশার সঞ্চার করেছে এই প্রতিবেদন তার প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কয়েক গণবিচ্ছিন্ন নেতাদের কথা শুনলে বোঝা যায়। তাদের এই প্রতিবেদন যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে নির্মিত তার প্রমাণ রেখেছে এই প্রতিবেদনের নামকরণে। তাই এটিকে ভিত্তিহীন, সন্ত্রাসী মদদপুষ্ট ও দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
এবার আসা যাক আল জাজিরা প্রযোজিত ‘All the Prime Minister’s Men’.ডকু ফিল্ম প্রসঙ্গে। বেশ ব্যায়বহুল এই ফিল্মে ক্যামেরার কাজ যে কারো নজর কাড়তে বাধ্য। ডিরেক্টর বেশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে সময় নিয়ে কাজটি করেছেন এ কথা বলতে হবে সবার। এ ফিল্মের সবচেয়ে নজর কেড়েছেন কয়েকটি প্রধান চরিত্র। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিত ডেভিড বার্গম্যান, মাদকাসক্তির অপরাধে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে বহিষ্কৃত ক্যাডেট জুলকারনাইন সায়ের খান (সামি ছদ্মনামধারী) এবং অখ্যাত নেত্র নিউজ-এর প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল। তাই সমকালীন রাজনীতির খবর না রাখা যে কোন দর্শক এই সিনেমা দেখে ভীষণ মুগ্ধ হবেন বলে মনে করি ।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রচারিত প্রতিবেদন নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে আমাদের। হারিস আহমেদের মুখে আমরা শুনছি বাংলাদেশের পুলিশ-ব়্যাব, এমনকি মন্ত্রীরাও তার কথায় চলেন উঠেন বসেন এবং নাচেন। কিন্তু সেটি তার দাবি, নাকি আসলেই ঘটনাটা এমন, তা প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট তথ্য প্রতিবেদনে দেখা যায়নি এই এখানে। সেনাপ্রধানের ভাইয়ের আওয়ামী লীগে ‘ব্যাপক প্রভাব’ থাকা সত্ত্বেও ইউরোপ-অ্যামেরিকা-ক্যানাডায় বিশ্বস্ত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে সামি নামের ব্যক্তির সঙ্গেই কেন সব লেনদেন করলেন, সেটাও স্পষ্ট নয় এই ডকু ফিল্মে।
এই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড একনায়কতন্ত্র ও বাকশাল গঠন করার কারণে হয়েছিল এমন ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে বলে মনে করি। যা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতির সামিল। বাঙালির জাতির পিতাকে তারা শুধু শেখ মুজিব বলে সম্বোধন করতে দেখা যায়। যে ভাষা পলাতক আসামি তারেক জিয়ার মুখে বেশি শোনা গেছে কয়েক বছর ধরে। শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আসা নিয়ে এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে তাঁর রাজনীতিতে আসা। অথচ বঙ্গবন্ধু কন্যার ফিরে আসা বাংলাদেশের কত বড় দুঃসময়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির আহবানে আশার বাতিঘর হয়ে সে দেশে এসেছিল সেই কথা কে না জানে।
আল জাজিরার ১ ঘণ্টার প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে মাফিয়া দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কি অপচেষ্টাই না করতে দেখলাম। প্রতিবেদনের শেষ হিসেবে সামীকে দিয়ে যা বলানো হয়েছে ‘ইফ দিস রেজিম কন্টিনিউ, কান্ট্রি উইল টেক টার্ন এজ মাফিয়া স্টেটস’। এই কথার ভিত্তি কিংবা গ্রহণযোগ্যতা নেই। কিন্তু আল জাজিরা কিভাবে ভুলে গেলো বিশ্বের আলোচিত ঘটনা ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আমাদের মানবিক প্রধানমন্ত্রী নিজের দেশের জন্য হুমকি জেনেও আশ্রয় দিলেন এবং লালন পালন করছেন। বিশ্ব নেতাদের স্বীকৃতি এবং উপাধি তাদের নজরের বাইরে গেলো কিভাবে ভেবে পাই না। করোনা সংকট মোকাবেলা করে দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশকে বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত করা নেতা শেখ হাসিনাকে এমন করে তুলে ধরা কোনভাবে মানসম্মত গনমাধ্যমের কাজ হতে পারে না।
আমাদের দেশের সেনাবাহিনী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের পাহারাদার। তাদের সব দলিল সিভিলিয়ানদের জন্য নন ডিসক্লোজার সাবজেক্ট। ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার পরও যদি তাদের কাছ থেকে কোনো সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে তাহলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কৃতিত্বের দাবি রাখে। এ ব্যাপারে কথা বলা আর সেনা বিদ্রোহে উস্কানি দিয়ে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। তারা ভেবেছিল ইজরাইল নামক রাষ্ট্রটিকে জড়িয়ে প্রতিবেদন করলে এদেশের পাকিস্থান পন্থি উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
এই প্রতিবেদনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে সাধারণ দর্শককে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, “কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে-কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন, ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে-কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।” সংবিধান ছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যেকোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয় সেই শর্তে তার দণ্ড কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশ বিশেষ মওকুফ করতে পারবেন।’
সম্প্রতি আমরা দেখেছি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে সাবেক বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাভোগরত ছিলেন। বর্তমান সরকার ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) ধারার ক্ষমতা বলে মানবিক কারণে দণ্ড স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছেন। বেগম জিয়ার সঙ্গে বর্তমান সরকারের প্রীতির সম্পর্ক নয়, বরং এক ধরনের বৈরিতার সম্পর্ক থাকার পরেও শেখ হাসিনার ক্ষমতাবলে এই সরকার তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন।
আলজাজিরার ডকু ফিল্মের অন্যতম প্রধান চরিত্র আলোচিত ‘সামি’র বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজে অংশ নেওয়া, সেনানিবাসে নিষিদ্ধ হওয়াসহ নানা অপরাধে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে তারা। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সামি কখনো তানভীর সাদাত, কখনো শায়ের জুলকারনাইন, কখনো বা জুলকারনাইন শায়ের খান সেজে প্রতারণাসহ অগণিত অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। র্যাব কর্মকর্তা পরিচয়ে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে ২০০৬ সালে র্যাবের হাতে গ্রেফতারও হয়েছিল সামি। সর্বশেষ গুজব ও অপপ্রচারের অভিযোগে ২০২০ সালের মে মাসে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামি এই মুখোশধারি সামি।
আলজাজিরার ডকু ফিল্মের আরেকটি অন্যতম চরিত্র ডেভিড বার্গম্যান। বাংলাদেশে একটি অতিপরিচিত নাম ডেভিড বার্গম্যান। যুদ্ধাপারাধ বিচার ঠেকাতে জামায়াতে ইসলামের লবিস্ট হিসেবে কাজ করা ড. কামালের এই জামাতাকে দেখে গেল অন্যতম চরিত্রে। এই ব্যক্তির চেহারা দেখে অনেকের কাছে স্পষ্ট কাদের অর্থায়নে এই প্রতিবেন করা হয়েছে এবং কেন করা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে এর আগেও বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ রয়েছে। আল জাজিরাকে বাংলাদেশ বিরোধী এজেন্ডায় সম্পৃক্ত করার পেছনে বার্গম্যান এর সংশ্লিষ্টতা আজ দেশবাসির কাছে স্পষ্ট।
এছারা সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাৎ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ এর কথা বলা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। যা বাংলাদেশে সম্ভব নয় প্রোটোকলের কারণে। বাংলাদেশে এমন কোন নজির নাই যে, প্রধানমন্ত্রী কখনো সেনাপ্রধানের সাথে দেখা করতে গেছেন। প্রতিবেদনের প্রথমেই লেখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর লোক মোহাম্মদ হাসান। কিন্তু প্রতিবেদনের কোথাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হারিসের সংশ্লিষ্টতা দেখাতে পারেননি আল জাজিরা। এখানে রাষ্ট্রীয় ক্রয়ে মিডলম্যান হিসেবে কাজ করেন হারিস। এর প্রমাণ হিসেবে সেনাবাহিনীর জন্য গুলি কেনার একটা ড্রিলে ডিজিএফআইয়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন এমন দৃশ্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু এসব কেনাকাটা ডিজিএফআইয়ের কাজ নয়। এটা করে ডিজিডিপি। এখানে এনিমেশনের মাধ্যমে দেখানো হলো, ১৯৯৬ সালে মোস্তাফিজুর রহমানকে হারিস বাহিনী খুন করল। কিভাবে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ডাইয়িং ডিক্লেয়ারেশন দিলেন। তার পরিষ্কার কোন ব্যাখ্যা নেই। জেনারেল আজিজের একটা অডিও রেকর্ড তুলে ধরা হল কিন্তু সেই কথা কার সাথে বলা হচ্ছে তা প্রকাশ করা হয়নি প্রতিবেদনে। এমন অসংখ্য অসংগতি রেখে আল জাজিরা তাদের বহু সময়, শ্রম আর অর্থের অপচয় করে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টের নামে যে ডকু ড্রামা ফিকশন শেষ করলো তার কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। কাতারের যুবরাজদের টাকায় চলা এই সংবাদমাধ্যমকে কি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলা যায় নাকি এজেন্ডা বাস্তবায়নকারি সংস্থা বলা হবে তা আগামীদিনের পাঠক ও দর্শক ঠিক করুন।
এ টি