আসাদুজ্জামান তপন : বাংলাদেশের ওপর আরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসছে। মানবাধিকার ইস্যু ছাড়াও গণতন্ত্র খর্ব, রাজনৈতিক নিপীড়ন, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে জড়িত সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ওপর চলতি মাসেই নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে যে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের দূরত্ব যেন কমছেই না। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, নির্বাচন ইস্যুতে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিকে ফেরত না দেওয়া এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগ সরকার যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নাখোশ, তা বেশ দৃশ্যমান। তবুও দুই সরকারের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, নিয়মিত অংশীদারি সম্পর্ক এবং কূটনৈতিক যোগাযোগও অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন। এমনকি নির্বাচন ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেক নমনীয় স্বরে বক্তব্য দিচ্ছে। এরই মধ্যে ফের নিষেধাজ্ঞার আভাসে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে—যুক্তরাষ্ট্র কি বর্তমান সরকারকে চাপে রাখতে চাইছে? কোন স্বার্থ হাসিলে মার্কিন এই চাপ?
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য টানাপোড়েন শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানানো হয়, র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের অভিযোগ আমলে নিয়ে তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়। এ ছাড়া এলিট ফোর্স র্যাবের জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অবদানও যুক্তরাষ্ট্রের অজানা নয়। তবুও গত দেড় বছরে র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। এমন অবস্থায় ফের নিষেধাজ্ঞার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নতুন এই নিষেধাজ্ঞার তথ্য জেনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্য ও সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করছেন।
সরকার প্রধানের মার্কিন সমালোচনা আরও কঠোর হয় চলতি বছর। গত ১০ এপ্রিল জাতীয় সংসদে বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যে কোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে—এমন মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। এরই মধ্যে আগামী নির্বাচনের আগে দলকে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি যে কোনো ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নেতাকর্মী-সমর্থকদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না এমন মন্তব্য করেন সরকার প্রধান।
র্যাব প্রসঙ্গে বিবিসিকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে, তাদেরই প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বাহিনীটি তারা যেভাবে তৈরি করেছে, সেভাবেই কাজ করছে। তাহলে কেন তারা এই নিষেধাজ্ঞা দিল?
ফের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সঙ্গে শুধু রাজনৈতিকই নয়, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এমনকি কৌশলগতভাবেও জড়িত। তাই বৈশ্বিক প্রত্যাশা বিবেচনায় রেখে কাজ করলে নিষেধাজ্ঞার মতো চ্যালেঞ্জগুলো এড়ানো সম্ভব হবে।
যে কারণে ফের নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা: বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারকে চাপে রাখতে নিষেধাজ্ঞার কৌশল নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ চাপ অবশ্যই বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন তাদের ফোকাস নয়। যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীনবিরোধী শক্তিশালী বলয় তৈরি করতে চায়। যেখানে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। আর বাংলাদেশ সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’—এই পররাষ্ট্র নীতি স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ঘোষিত বহুল আলোচিত ভারত মহাসাগরীয় রূপরেখায়ও (ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক) শেখ হাসিনার সরকার স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ ভাবনার কথা তুলে ধরেছে। স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের চেয়ে এই ভাবনা ভিন্ন, যা বাইডেন প্রশাসনকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
গত দেড় দশকে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক দৃঢ় সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্পর্ক আরও জোরদার করার পাশাপাশি ভারসাম্যের কূটনীতি বজায় রেখেছে শেখ হাসিনার সরকার। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-রাজনীতি, ভূ-অর্থনীতি ও কৌশলগত নানা কারণ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বাংলাদেশকে নিজেদের বলয়ে রাখতে মরিয়া বিশ্বের দুই পরাশক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে এবং যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে। দুই শক্তিধরের সঙ্গে সম্পর্কের রসায়নও ভিন্ন। তবুও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশের সরকারের প্রভাব বলয়ে এবং নীতিনির্ধারক মহলে চীনের প্রভাব একচেটিয়া হয়ে গেছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অ্যাকুজিশান অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট (আকসা) ও জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া) সই করতে চায়। এই দুটি চুক্তির অধীনে মার্কিন বাহিনী খাদ্য, জ্বালানি, গোলাবারুদ, সামরিক সরঞ্জামাদি সামরিক গোয়েন্দা তথ্যের বিনিময় করতে চায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বহুজাতিক জ্বালানি করপোরেশন শেভরন স্থানীয় গ্যাসের সিংহভাগ উৎপাদন করে। টেক্সাসভিত্তিক প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এক্সেলারেট এনার্জি মহেশখালীতে দুটি ভাসমান স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে বাংলাদেশে এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন সেবা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের উপকূলে অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন তেল উৎপাদন প্রতিষ্ঠান এক্সনমোবিলসহ বেশ কিছু কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার সব উন্মুক্ত গভীর পানির অফশোর ব্লক ও কিছু অনশোর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব প্রস্তাব বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার বিবেচনায় সতর্কতার সঙ্গে খতিয়ে দেখছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্বের নেপথ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের অতিমাত্রায় চীন সংবেদনশীলতা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, মন্ত্রী হওয়ার আগে এ কে আব্দুল মোমেন একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের লবিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা রয়েছে, যা মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের টানাপোড়েনে ভস্মে ঘি ঢেলেছে।
এক নিষেধাজ্ঞা চলমান থাকতে নতুন নিষেধাজ্ঞা এলে মাঠের রাজনীতিতে কোণঠাসা বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর জন্য মেঘ না চাইতে জলের জোগান দেবে। এর ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলনও চাঙ্গা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ কালবেলাকে বলেন, র্যাবের ওপর স্যাংশনের পরও গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ হয়নি। আমাদের নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কোনোভাবেই চাই না যে, এ দেশের কোনো নাগরিকের ওপর কোনো ধরনের স্যাংশন আসুক। কারণ, এর প্রভাবটা শুধু সেই ব্যক্তির ওপর সীমাবদ্ধ থাকে না, পুরো দেশ এবং দেশের অন্য নাগরিকের ওপর এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু কোনো একটি সংস্থা বা ব্যক্তি যদি এই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করতেই থাকে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই স্যাংশন আসতে পারে। তবে সেই সিদ্ধান্ত তো স্যাংশন আরোপকারী দেশগুলো নেবে, এক্ষেত্রে আমাদের বলার কিছু নেই।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন দেওয়ারও নজির আছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খর্ব করায় কিছুদিন আগে নাইজেরিয়ার কিছু ব্যক্তির ওপর স্যাংশন দিয়েছে তারা। আমাদের নির্বাচন কমিশন যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে সরকারের তাবেদার হিসেবে থেকে ভোট চুরিতে সহায়তা করে, তাহলে ইসিকে তো প্রথমে বাংলাদেশের জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো উচিত। আর আন্তর্জাতিকভাবে যারা এ দেশে গণতন্ত্র এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলছে, তারা যদি দেখে যে সেটা নিশ্চিত হচ্ছে না, তারা পদক্ষেপ নিতে পারে, সে নজির আছে। এখানে বিএনপির কোনো বক্তব্য নেই।
নিষেধাজ্ঞার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত সরকার: নতুন করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছে না সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা। বরং গত দেড় বছরে বেশ দৃঢ়ভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে নিষেধাজ্ঞার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—বিশ্বের দুই পরাশক্তিই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। ওই সময় বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করে ভারত ও রাশিয়া। সেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালে স্বীকৃতি দিলেও চীন দেয় ১৯৭৫ সালে। গত ৫২ বছরেও বহুমাত্রিক সম্পর্কে উন্নীত হলেও ওয়াশিংটন ঢাকার বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ এর চেয়েও কম সময়ে চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার হয়ে গেছে। এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপিরবারে হত্যা, ওয়ান-ইলেভেনসহ নানা সময়ে বিভিন্ন অপতৎপরতায় জড়িত ছিল ওয়াশিংটন। এমনকি বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাশেদ চৌধুরীকেও ফেরত দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। বরং প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা সরকারকে চাপে রেখে বিশেষ স্বার্থ বাগিয়ে নিতে চায়। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশের তেল-গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ওই নির্বাচনে তার দলকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’ এবারও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার চাপে রেখে শেখ হাসিনার সরকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে। কিন্তু এবারের শেখ হাসিনা আরও শক্তিশালী এবং আরও দূরদর্শিতার সঙ্গে দেশি-বিদেশি চাপ মোকাবিলায় নিজেই মাঠে রয়েছেন।
ইতোমধ্যে বৈশ্বিক ডলার সংকট মোকাবিলায় সরকারপ্রধানের নির্দেশনায় বিকল্প মুদ্রার জোট ব্রিকসে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এর ফলে কমবে মার্কিন ডলারের আধিপত্য। বৈশ্বিক বাণিজ্যের লেনদেনের মাধ্যম হবে নতুন মুদ্রায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ভারত, চীন, সৌদি আরব ও রাশিয়ার সঙ্গে নিজ নিজ মুদ্রায় লেনদেনের পথেও অগ্রসর হচ্ছে। এমনকি দেশি পণ্যের বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প বাজার খুঁজতেও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইইউ ছাড়াও নতুন বা অপ্রচলিত বাজার হিসেবে পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই), মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে এখন বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
এ ছাড়া পরীক্ষিত বন্ধু ভারত ও জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক বেশি নিবিড় হয়েছে। যদিও ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। আর প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক টোকিও সফরে দুই দেশ অংশীদারি সম্পর্কে পা রেখেছে। বাংলাদেশ চীনের বিনিয়োগে ভারসাম্য আনতে জাপানি বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। জাপানের দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি) প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় যাবে। বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক ভাবনাকেও স্বাগত জানিয়েছে জাপান। এসব কিছুই মার্কিন বলয়ে কুক্ষিগত না থেকে স্বতন্ত্রভাবে এগিয়ে চলার দৃঢ় মনোভাব।
অন্যদিকে, বিশ্বজুড়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসিত হচ্ছে। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করা বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকটির নতুন প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অজয় বাঙ্গা। আইএমএফের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রভাব রয়েছে। স্বভাবতই বলিষ্ঠ নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতি তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় আসতে পারেন—এমন আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব কিছুই বার্তা দেয়, বর্তমান সরকার এখন রাজনৈতিকভাবে আরও সুদৃঢ় ও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। আর প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ বক্তব্য নেতাকর্মীদের মানসিক শক্তিও আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া ভারত ও চীনের সহযোগিতা তো রয়েছেই। বিশেষ করে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে সম্মানিত অতিথির মর্যাদা দিয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ সম্মান দিয়েছে। এই সম্মেলন ঘিরে উন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও জোরদারের সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশ দশ বছর আগের সেই দেশ নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বকে এটা মানতে হবে। এদেশের নিজস্ব শক্তি, বহুমাত্রিক বন্ধুত্ব ও দৃঢ় নেতৃত্ব উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মডেল এখন। তাই কোনো একটি শক্তি চাইলেই বাংলাদেশ বা সরকারকে ফেলে দেবে, সেই অবস্থা যে আর নেই, সেই বার্তাই প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তার বিভিন্ন বক্তব্যে দিচ্ছেন। এ ছাড়া সরকার ইতোমধ্যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। আগামী সরকারও বাইরের কোনো শক্তি নয়, এ দেশের জনগণ নির্বাচন করবে।
নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় সরকার প্রস্তুত রয়েছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ কালবেলাকে বলেন, আমাদের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সব ধরনের প্রস্তুতিই আছে। আমরা দেশের জনগণের জন্য রাজনীতি করি। আমাদের সঙ্গে দেশের জনগণ আছে। সুতারাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরকম তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। জানি তারা প্রায়ই বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, দিতেই পারে। এটা তাদের নৈমিত্তিক বিষয়।