এনবি নিউজ : বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নতুন জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে ভোট দিচ্ছেন দুই নগরীর আট লাখের বেশি ভোটার; জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস আগে এ নির্বাচনে সবার নজর থাকবে ভোটের হারের দিকে।
নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, সোমবার সকাল ৮টায় দুই নগরীর ৪১৫টি ভোটকেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে।
গাজীপুরের মতই বরিশাল ও খুলনার কেন্দ্রে কেন্দ্রে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা, যার মাধ্যমে ঢাকায় বসে সরাসরি ভোটের পরিস্থিতিতে নজর রাখছে নির্বাচন কমিশন।
বিএনপি ভোটে অংশ না নিলেও ২৫ মে গাজীপুর সিটি নির্বাচন জমিয়ে দিয়েছিলেন এক স্বতন্ত্র প্রার্থী; তারপরও ভোটের হার ছিল ৪৮ শতাংশ।
সেই তুলনায় অনেকটাই নিরুত্তাপ বরিশাল ও খুলনার এবারের নির্বাচন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এই নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতিই বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
পাঁচ বছর আগে এই দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের চিত্র ছিল পুরোই ভিন্ন। গোলযোগ, অনিয়ম, এজেন্টদের মারধর ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ছিল ভোটের দিনও।
কিন্তু এবার সেসবের কিছুই বলতে গেলে নেই। দুই নগরেই মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
বরিশালে মেয়র পদে ৭ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১৫ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৪২ জন লড়ছেন।
খুলনা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে ৫ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৩৬ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৯ জন লড়ছেন।
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলছেন, ক্ষমতাসীন দল কিংবা নির্বাচন কমিশন দুই পক্ষের জন্যই এ দুই সিটির নির্বাচন চ্যালেঞ্জ ছাড়াই হতে যাচ্ছে।
“বড় একটি দল বিএনপি না থাকায় কোনো চ্যালেঞ্জ বা কঠোর পরীক্ষায় কাউকে পড়তে হচ্ছে না।… এমন পরিস্থিতিতে ভোটারকে কেন্দ্রে নিয়ে আসাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে খুলনায় এটা হতে পারে। ভোটার টার্নআউট তুলনামূলক কম হতে পারে।”
জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন হলেও তা আর কয়েক মাস পরের সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন না আলীম।
তিনি বলেন, “দুটো নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও তা সংসদ নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না। সামনে জাতীয় নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য হোক, সেটাই সবার প্রত্যাশা।”
কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন অবশ্য এবার গাজীপুরের চেয়েও ‘ভালো’ নির্বাচন উপহার দিতে চাইছে।
নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান ভোটের আগের দিন বলেছেন, “খুলনা ও বরিশাল সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। অনিয়মের সঙ্গে কেউ জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বরিশালের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন জানান, এই নগরীর ১২৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০৬টি কেন্দ্রকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এসব কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সোমবার ভোট শেষে বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তন থেকে ফলাফল ঘোষণা করবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
আর খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন জানান, নির্বাচনে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে। পুলিশ-আনসারের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করছেন র্যাব-বিজিবির সদস্যরা।
সোমবার ভোটগ্রহণ শেষে জেলা শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়াম থেকে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হবে বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা।
বরিশালে প্রার্থী যারা
>> পদ: মেয়র একজন, ৩০ জন সাধারণ কাউন্সিলর, ১০ জন সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর
>> ভোটার: ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৯ জন এবং নারী ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮০৯ জন।
>> কেন্দ্র/কক্ষ: ভোটকেন্দ্র ১২৬ ও ভোটকক্ষ ৮৯৪টি।
>> রিটার্নিং কর্মকর্তা: ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির।
খুলনায় মেয়র প্রার্থী যারা
>> পদ: একজন মেয়র, ৩১ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১০ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর।
>> ভোটার: ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন। পুরুষ ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৩ জন; নারী ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৬ জন।
>> কেন্দ্র/কক্ষ: ভোটকেন্দ্র ২৮৯টি; ভোটকক্ষ ১৭৩২টি।
>> রিটার্নিং কর্মকর্তা: ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন।
ভোটের হিসাব-নিকাশ
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, “বিএনপি নির্বাচনে এলে হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত। বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের সমর্থকদের কেন্দ্রে নিতে পারলেও বিএনপির কর্মীরা এবার সেভাবে ভোটকেন্দ্রে যাবেন বলে মনে হচ্ছে না।”
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব বাবুল হাওলাদার বলেন, “এবারের সিটি ভোট নিয়ে সাধারণ ভোটারদের আগ্রহ কম; যদিও কাউন্সিলর প্রার্থীরা সাড়া ফেলেছে।”
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের পাল্লা অনেকটাই ভারী।
বর্তমান মেয়র খালেক নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে রয়েছেন টানা ১৯ বছর। চার বারের সংসদ সদস্য, একবারের প্রতিমন্ত্রী এবং দুবারের মেয়র। তার স্ত্রী হাবিবুন নাহারও উপমন্ত্রী।
এদিকে ভোটের আগে বরিশালের নির্বাচনী পরিবেশ ভালো থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কিছু অভিযোগ করে আসছে।
প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের নানা অভিযোগের বিষয়ে নৌকার প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ (খোকন সেরনিয়াবাত) ভোটের আগের দিন বলেন, “যেহেতু আমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী, আমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে সবকিছু স্বাভাবিক ও চমৎকার পরিবেশে রয়েছে। এখানে কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”
ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের রোববারের মধ্যে বরিশাল নগরী ছাড়তে আহ্বান জানান জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস।
তিনি বলেন, “মানুষ আমাকে ধরে কান্নাকাটি করেছে- ভাই ভোটটা কি দিতে পারব না? তাই আমি সরকারের কাছে, আওয়ামী লীগের কাছে, আমার দলের কাছে, সিইসির কাছে অনুরোধ করছি তারা যেন বরিশালের মানুষের সঙ্গে অন্যায় আচরণ না করেন।
“আমরা সিইসিকে বলছি- আপনারা ওখান থেকে দেখবেন, প্রয়োজনে ভোট বন্ধ করে দেবেন,” বলেন লাঙ্গল প্রতীকের এ মেয়র প্রার্থী।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র পদপ্রার্থী মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীমও ভোট কিনতে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন।
তবে ভোটের আগে নগরীর বস্তি এলাকায় অর্থ বিতরণের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছন খোকন সেরনিয়াবাত।
বরিশালের এবারের নির্বাচনে ভোট ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে আওয়ামী লীগের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে মনোনয়ন না দেওয়া। নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত সম্পর্কে সাদিকের চাচা হলেও তাদের অবস্থান দুই মেরুতে।
ফলে আওয়ামী লীগে সাদিকের সমর্থকদের ভোট শেষ পর্যন্ত দলের পক্ষে পড়বে কি না, সেই সংশয়ও রয়েছে।
সিটির সঙ্গে ২ পৌরসভায় ভোট
কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার পৌরসভায়ও সোমবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এ দুই পৌরসভার বাসিন্দারাও ভোট দেবেন ইভিএমে।
কক্সবাজার পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মো. মাহাবুবার রহমান চৌধুরী নৌকা প্রতীকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জাহেদুর রহমান হাতপাখা প্রতীকে, স্বতন্ত্র থেকে হেলমেট প্রতীকে জগদীশ বড়ুয়া, মোবাইল ফোন প্রতীকে জোসনা হক, নারকেল গাছ প্রতীকে মাসেদুল হক রাশেদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ নির্বাচনে সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে রয়েছেন ৬৪ জন প্রার্থী।
আড়াইহাজার পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মো. সুন্দর আলী নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। স্বতন্ত্র থেকে জগ প্রতীকে মো. হাবিবুর রহমান, মোবাইল ফোন প্রতীকে মোহাম্মদ মামুন অর রশিদ ও নারকেল গাছ প্রতীকে মো. মেহের আলী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কাউন্সিলর পদে সাধারণ ও সংরক্ষিত রয়েছেন ৪৫ জন প্রার্থী রয়েছেন এ নির্বাচনে।