আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে পুলিশের সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) পর্যায়ক্রমে বদলির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশের সবচেয়ে বড় একক ইউনিট ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টির মধ্যে ৩৩ থানার ওসির রদবদল সংক্রান্ত নথি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রেঞ্জ থেকে পুলিশ সুপারদের (এসপি) কাছে ওসি রদবদলের জন্য পাঠানো আদেশ বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। সেই হিসেবে সারাদেশের পাঁচ শতাধিক থানার ওসি বদলি হতে পারেন বলে জানা গেছে। নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে রদবদলের চূড়ান্ত আদেশ বাস্তবায়ন হবে।
ওসি বদলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে চিঠি দেয় ইসি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে অনুলিপি দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার জন্য সব থানার ওসিদের পর্যায়ক্রমে বদলি করতে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে যেসব থানার ওসির বর্তমান কর্মস্থলে ছয় মাসের বেশি সময় পার হয়েছে, তাদের অন্য জায়গায় বদলির প্রস্তাব ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো প্রয়োজন। ইসির এই নির্দেশের পরই পুলিশের নীতিনির্ধারকরা ৬ মাসের বেশি সময় কোনো থানায় কর্মরত ওসিদের তালিকা তৈরি শুরু করেন। মহানগর ও রেঞ্জসহ ইউনিটভিত্তিক পৃথক তালিকা তৈরি কাজ শুরু হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশে ৬৩৬টি থানা রয়েছে। সাধারণত নির্দিষ্ট সংখ্যক পরিদর্শকই ঘুরেফিরে থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করেন। তার মধ্যে অধিকাংশ থানার ওসি ছয় মাসের বেশি তার কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করছেন। রাজশাহী রেঞ্জে থানা রয়েছে ৭১টি। এর মধ্যে ৩০ জন ছয় মাসের বেশি একই থানায় রয়েছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে থানা রয়েছে ১৬টি। এরমধ্যে পাঁচজন ছয় মাসের বেশি দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ঢাকা রেঞ্জের এক কর্মকর্তা জানান, ৯৮টি থানা রয়েছে তাদের রেঞ্জের আওতাধীন। ছয় মাসের বেশি দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ওসির তালিকা তারা তৈরি করেছেন।
একাধিক রেঞ্জ ডিআইজি জানিয়েছে, ওসিদের রদবদল করে জেলার ভেতরে অন্য কোনো থানায় দেয়া হতে পারে। আবার একেবারে নতুন মুখও আসতে পারে। জেলা বা ইউনিটের বাইরে থেকেও কারো-কারো ভাগ্য খুলতে পারে; আবার কারো কপাল পুড়তে পারে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কমিশনার মোজাম্মেল হক জানান, কেএমপির মধ্যে ৮টি থানা রয়েছে। এর মধ্যে ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ থানার ওসিকে বদলির প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।
এদিকে পুলিশের সবচেয়ে বড় একক ইউনিট ডিএমপিতে ৫০টি থানার মধ্যে ৩৩ থানার ওসি পদে রদবদল আসছে। রাজধানীর আটটি অপরাধ বিভাগের আওতাধীন ৫০টির মধ্যে ১৭টি থানার ওসির মেয়াদ এখনো ৬ মাস পূর্ণ হয়নি। বাকি ৩৩ থানার ওসি ছয় মাসের বেশি সময় ধরে একই থানায় রয়েছেন। ইসির নির্দেশনার পর নতুনভাবে কাকে কোনো থানায় দায়িত্ব পালনের জন্য বেছে নেয়া হচ্ছে এমন একটি খসড়া তালিকা এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। ইসির অনুমোদন পেলে সেখানে তাদের পোস্টিং করা হবে।
ডিএমপির মিরপুর বিভাগের মধ্যে রূপনগর ও কাফরুল ছাড়া বাকি পাঁচ থানার ওসি পদে নতুন মুখ আসছে। ডিএমপির উত্তরা বিভাগের ছয় থানার মধ্যে চারটির ওসি রদবদল হচ্ছে। সেগুলো হলো- উত্তরা পূর্ব, উত্তরা পশ্চিম, তুরাগ ও উত্তরখান। তেজগাঁও বিভাগের শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি বদল হচ্ছে।
ডিএমপির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে যাদের রদলি করা হচ্ছে, তাদের ইউনিট পরিবর্তন হচ্ছে। নির্বাচনী আসনের বাইরে গিয়ে অন্য থানায় নতুন ওসি হিসেবে দায়িত্ব পাবেন। গতকাল রবিবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, গত ৩০ নভেম্বরের নির্বাচন কমিশনের পত্রের আলোকে ডিএমপির যে সব থানার ওসি বর্তমান কর্মস্থলে ৬ মাসের বেশি চাকরিকাল সম্পন্ন করেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তাদের অন্যত্র বদলির প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য শিগগিরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব (পুলিশ-১ অধিশাখা) মো. আবুল ফজল মীর এ প্রতিবেদককে জানান, পুলিশ সদর দপ্তরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে ইসির নির্দেশনা ও চাওয়া মোতাবেক কতজন ওসি বদলি হচ্ছেন। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর কাজ করছে। আশা করছি আজ সোমবারের মধ্যে কতজন ওসি বদলির তালিকাভুক্ত হচ্ছেন সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যাবে। ৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই ওসি বদলির চূড়ান্ত তালিকা আমরা নির্বাচন কমিশনে পাঠাব।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী মেট্রোপলিটন এলাকা বাদে বদলি হওয়ার মতো বিভিন্ন রেঞ্জের অধীন ৪২৮ থানার ওসির তালিকা তারা এখন পর্যন্ত পেয়েছেন। সব তালিকা পেলে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। সেখানে যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত তালিকা যাবে নির্বাচন কমিশনে যাবে।
তবে হঠাৎ বদলির আদেশে বিপাকে পড়েছেন ওসিরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ওসি বলেন, ভোটের আগে নতুন কর্মস্থলে গিয়ে বুঝে উঠতেই সময় লাগবে। একবারে গণবদলি না করে অভিযোগসাপেক্ষ ব্যবস্থা নেয়া যেত। এ নিয়ে বিব্রত হতে হচ্ছে। তবে এর বিপরীতও রয়েছে। অনেক ওসি ইতোমধ্যে চেষ্টা-তদবীর করে পছন্দের বদলির তালিকায় নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে, গতকাল রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা। যখনই নির্বাচন আসে, শিডিউল ডিক্লেয়ার হয়ে গেলেই আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী থেকে শুরু করে সবকিছুই নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকে। নির্বাচন কমিশন মনে করেছে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যারা দীর্ঘদিন যাবত ওসি হিসেবে আছেন, তারা হয়ত কারো প্রতি ইনক্লাইন্ড (অনুগত) হতে পারে। ওসিদের নিয়ে এ ধরনের বিবেচনা নির্বাচন কমিশনের, আমাদের কিছু নয়। এজন্যই তারা সারাদেশে ওসিদের ট্রান্সফার করেছে। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারাদেশে ওসিরা কাজ করছে।