ডা: আব্দুস সালাম : ঢেলে সাজানো হচ্ছে পদ্মা সেতু এবং আশপাশ এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জোরদার করা হচ্ছে ফেরি চলাচল রুটের ওপর সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা। ফেরি কোন রুটে, কত গতিতে চলছে, তা মনিটরিংয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ফেরিতে কর্মরত চালক ও কর্মচারীদের ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য সংগ্রহ এবং তাদের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়াতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া পদ্মা সেতুর পিলারে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন এবং তা পর্যবেক্ষণ কীভাবে করা হবে, এ নিয়েও জোর আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। ফেরি যাওয়া-আসার পৃথক রুট চিহ্নিত করে সেগুলো মার্কিং করে দেওয়া হচ্ছে। পদ্মা সেতুর পিলারে পাঁচবার আঘাতের ঘটনায় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এসব পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। এরপরই নড়েচড়ে বসেছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলাম গতকাল শনিবার এনবি নিউজকে বলেন, ফেরি চলাচল নিরাপদ ও সেতুর নিরাপত্তায় টেকনিক্যাল কমিটির যেসব সিদ্ধান্ত আমাদের বাস্তবায়ন করতে বলেছে, সেগুলো কার্যকর করছি। আমি নিজেই শিমুলিয়ায় অবস্থান করে এসব কাজ মনিটর করছি। তিনি বলেন, ফেরি চলাচল সঠিকভাবে করছে কি না, সেজন্য পদ্মা সেতুর পিলারে সিসি ক্যামেরা বসানো হবে। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটের ১৭টি ফেরিতে ভিটিএস (ভ্যাসেল ট্র্যাকিং সিস্টেম) বসানো হয়েছে। সেগুলো কার্যকর করা হচ্ছে। এ রুটের ফেরির ৮০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছে। যাদের রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে, তাদের বদলে অন্যদের পদায়ন করা হবে।
জানা গেছে, জুলাই ও আগস্টে পদ্মা সেতুর পিলারে পাঁচবার ধাক্কা দেয় বিআইডব্লিউটিসির ফেরি। এর মধ্যে দুটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি। সর্বশেষ গত শুক্রবার সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ফেরি কাকলীর আঘাতের ঘটনায় শনিবার পর্যন্ত তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। তবে ওই ফেরিতে ভিটিএস তথ্য পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন, ওইদিন সকালে আকস্মিক ঝড় ও বৃষ্টি হলে চালক নিয়ম না মেনেই সংক্ষিপ্ত পথে পদ্মা নদী পার হতে গিয়ে পিলারে ধাক্কা দেয়। এ ঘটনায় ওই ফেরির দুই চালককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর আগে গত সোমবার (৯ আগস্ট) বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ফেরির সেতুর পিলারে আঘাত দেওয়ার ঘটনায় গঠিত কমিটি শনিবার পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান। এর আগে ২৩ জুলাই শাহজালাল ফেরি ১৭ নম্বর পিলারে আঘাত দেওয়ার ঘটনায় দুটি কমিটি তাদের প্রতিবেদনে চালকের অবহেলা, গাফিলতি ও উদাসীনতাকে দায়ী করেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা এনবি নিউজকে জানান, এসব ঘটনায় ফেরি পরিচালনাকারী সংস্থা বিআইডব্লিউটিসির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলায় ঘাটতি, ফেরি পরিচালনায় দুর্বলতা ও ত্রুটির বিষয়গুলো উঠে আসে। সংস্থাটির ‘চেইন অব কমান্ড’ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের উপস্থিতিতে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত দুই বৈঠকে নানাভাবে এসব বিষয় উঠে আসে। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে অফিসার্স ক্লাবে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কাকলী ফেরির চালক ত্রুটির কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছে কি না, দিয়ে থাকলে ওইসব ত্রুটি সারাতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না, চালক সঠিক তথ্য দিয়েছে কি না-এসব বিষয় যাচাইয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে কর্মকর্তারা জানান, তারা এ ধরনের কোনো চিঠি পাননি। তখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ওই চিঠির কপি উপস্থিত কর্মকর্তাদের দেখান। বৈঠকে বিআইডব্লিউটিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সতর্কও করে দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের কমান্ড কেন মাঠপর্যায়ে প্রতিফলিত হয় না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। চালকের গাফিলতিতে ফেরি সেতুর পিলারে ধাক্কা দিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রয়োজনে পুলিশে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়া বৈঠকে বিআইডব্লিউটিসির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও ফেরির জ্বালানি তেল খরচ নিয়েও আলোচনা হয়।
সেতুর পিলারে বারবার ধাক্কা দেওয়ার ঘটনায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। অফিসার্স ক্লাবে অনুষ্ঠিত ওই দুই সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, নৌসচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী, সেতু বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক, বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন।
ওইসব বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবি নিউজকে জানান, সর্বশেষ বৈঠকে পদ্মা সেতু ও ফেরির নিরাপত্তা বিষয়গুলো বেশি আলোচিত হয়। বৈঠকে জানানো হয়, ফেরির আঘাতে সেতুর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে বারবার আঘাত লাগার ঘটনায় আলোচনার জন্ম নিচ্ছে। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটের ফেরির চালক ও কর্মচারীদের বিষয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পদ্মা সেতু ও আশপাশ এলাকায় সমন্বিত নিরাপত্তা আরও জোরদার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী, সেতু বিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি যৌথভাবে মনিটরিং করবেন এবং ওই এলাকায় নেওয়া পদক্ষেপ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
জানা যায়, শুক্রবারের বৈঠকে বিআইডব্লিউটিএকে আসা-যাওয়ার পৃথক পথ চিহ্নিত করে সেখানে মার্কিং করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শনিবার রুট চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি। প্রাথমিক আলোচনা অনুযায়ী, শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার যেতে ফেরি ৩ ও ৪ নম্বর পিলারের মাঝ বরাবর চলবে। আর বাংলাবাজার থেকে শিমুলিয়া আসতে ৪ থেকে ৭ নম্বর পিলারের মাঝে চলবে।
এছাড়া ফেরি নির্দিষ্ট রুটে চলল কি না, ফেরির গতি কী পরিমাণ ছিল, তা মনিটরিং করতে ভিটিএসসহ অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিটি ফেরিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ওয়াকিটকি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যাতে কোনো ফেরি ভুল রুটে চললে ওই চালককে নির্দেশনা দেওয়া যায়।
আরও জানা যায়, পদ্মা সেতুতে সিসি ক্যামেরা বসানো নিয়ে আলোচনা হয়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সেতু নির্মাণের পর এক বছর তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকবে। সেতুতে সিসি ক্যামেরা বসানো হবে। প্রকল্প আওতায় এসব ক্যামেরা স্থাপন ও মনিটরিং করা হবে। বৈঠকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা থাকবেন, তাদের সঙ্গে শেয়ার করা যায় কি না, তা নিয়েও আলোচনা হয়।
এর আগে শুক্রবার সকালে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুট ও ফেরির কার্যক্রম পরিদর্শন করেন নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ওই সময় তিনি ফেরির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেন। প্রতিমন্ত্রী নিজেই নতুন সংগ্রহ করা দুটি ফেরিতে মেকানিক্যাল ত্রুটি ও ফেরি পরিচালনায় নানা অসংগতি দেখতে পান এবং ওইসব ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে বলেন।
অন্যতম কারণ চ্যানেল পরিবর্তন : মন্ত্রিপরিষদ সচিবের উপস্থিতিতে বৈঠকে দেওয়া কয়েকজন কর্মকর্তার বক্তব্য পর্যালোচনা এবং বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, চ্যানেল পরিবর্তন এসব ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। গত বছর ২৩ থেকে ২৬ নম্বর পিলারের মাঝ দিয়ে লোহজং টার্নিং পয়েন্ট দিয়ে ফেরি চলাচল করত। সেখানে সে স্রোত খুবই কম ছিল। তবে চরের সমস্যা থাকায় অক্টোবর ও নভেম্বরে ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। নদী শাসনের কাজে ওই এলাকায় ক্লোজার ড্যাম নির্মাণ করায় ওই রুটটি বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে হাজরা চ্যানেল দিয়ে ফেরি চলাচল করছে, যেখানে স্রোতের তীব্রতা অনেক বেশি। শনিবার পদ্মা সেতুর ৫ থেকে ৬ নম্বর পিলারে মাঝ বরাবর সর্বনিম্ন ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৬০ কিলোমিটার এবং ১৯ ও ২০ নম্বর পিলারের মাঝ বরাবর ঘণ্টায় সর্বোচ্চ প্রায় ১২ কিলোমিটার তীব্রতায় স্রোত ছিল। অথচ ফেরির গতি আকারভেদে সাত কিলোমিটার থেকে ১১ কিলোমিটার। যে ১০ নম্বর পিলারে দুইবার ফেরি আঘাত করেছে, সেখানেও শনিবার ঘণ্টায় সাত থেকে আট কিলোমিটার তীব্রতার স্রোত ছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, সেতুর পিলারে বারবার ধাক্কা লাগার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে স্রোতের এ তীব্রতা। এছাড়া ফেরি মেরামতে অনিয়ম, পুরোনো ইঞ্জিন, চালকের অদক্ষতা ও অবহেলাও অন্যতম কারণ।