এজে তপন : রাজপথে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা প্রায় ২ বছর ধরে অচল। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১০টি সিগন্যাল পয়েন্টের মধ্যে সচল মাত্র একটি। ৬৫৪টি সিগন্যাল পোস্টের প্রায় তিন হাজার রঙিন বাতি মৃত প্রায়।
ট্রাফিক বিভাগ বলছে- এ শহরে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের চলাচল। এদের জন্য ট্রাফিক পুলিশ থাকার কথা প্রায় ১০ হাজার। কিন্তু আছে মাত্র ৩৮০০। এসব কারণে শত চেষ্টা করেও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বিভাগটির সদস্যরা। প্রায় যানজট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান এনবি নিউজকে বলেন, রাজধানীতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের সঙ্গে বাড়ছে মানুষও। প্রায় ২ বছর ধরে পুরো ট্রাফিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ১১০টি সিগন্যাল পয়েন্টে শত শত লাইট নষ্ট হচ্ছে। ২-১টা ছাড়া সবকটি অচল। ২-১টি পয়েন্টে বাতি জ্বললেও হাতেই সিগন্যালগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাজধানীতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা খুব একটা কাজে আসছে না। একেকটি পোস্টে-এলাকার অবস্থার ভিত্তিতে-টাইম সেট করতে হয়। কোনো পয়েন্টে ৩ মিনিট আবার কোথাও ১০ মিনিট পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ রাখতে হয়। ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে গবেষণা করাচ্ছি। এতে বের হয়ে আসবে, কি করতে হবে-কি পরিমাণ লোকবল ও বরাদ্দ প্রয়োজন। তবে, এজন্য বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে। এতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, আড়াই কোটি মানুষের শহরে ট্রাফিক সদস্য আছেন ৩৮০০। প্রয়োজন আরও অনেক বেশি।
জানা গেছে, ২০০০ সালে ঢাকা শহরে গুরুত্বপূর্ণ ৭০টি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত বাতি বসানো শুরু হয়। ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কাজটি হাতে নেওয়া হয়। ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় এই কাজ শেষ হয় ২০০৮ সালের দিকে।
কিন্তু ব্যবহার না হওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কয়েক মাসের মধ্যেই অধিকাংশ বাতি অকেজো হয়ে পড়ে। এরপর ২০০৯ সালে আবারও এ ধরনের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সে বছরের নভেম্বরে নগরের অর্ধশতাধিক মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে স্বয়ংক্রিয় সংকেত বাতি ব্যবহার করে পুলিশ। কিন্তু মাত্র ১ দিনের মধ্যেই এ স্বয়ংক্রিয় সংকেত যানজট বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় দিনই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির পরিবর্তে পুলিশ হাতের ইশারা ও বাঁশি বাজানো ব্যবস্থায় ফিরে যায়।
অপরদিকে ২০১০-১১ অর্থবছরে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস)’ নামে আরেকটি প্রকল্প নেয় সিটি করপোরেশন। তখন প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত সরঞ্জাম কেনা হয়।
বিশেষ এলাকা চিহ্নিত করে ২০১৫ সালে কাকলী থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ১১টি পয়েন্টে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত ব্যবস্থাও চালু করা হয়। এতে যানজট আরও তীব্র হয়ে উঠে। ২০১৯ সালের মার্চে পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ে।
গত দু’সপ্তাহ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষা ভবন সড়ক মুখের চারপাশে ১২টি সিগন্যাল পোস্ট রয়েছে। এগুলোতে লাল, সবুজ, হলুদ ৩৬টি বাতি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
এ মোড় দিয়ে খোদ রাষ্ট্রপ্রতি-প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা চলাচল করেন। ট্রাফিক কর্মকর্তা (টিএসআই) মনির হোসেন এনবি নিউজকে বললেন, গাধার মতো খাটি, যানচালক থেকে শুরু করে পথচারী-তাদের মানুষ বলেই গণ্য করে না।
বাঁশের লাঠি আর নামে মাত্র বাঁশি দিয়েই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। গুলিস্তান জিরোপয়েন্ট মোড়, ১০টি পোস্ট অচল। শাপলা চত্বর ইন্টারসেকশন, কখন স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল- তা খোদ ট্রাফিক সদস্যরাই জানেন না। ইত্তেফাক মোড়ে- ৮টি সিগন্যাল খুঁটির ২৪টি বাতি জ্বলে না বহু বছর ধরে।
গোলাপশাহ মাজার থেকে কাকরাইল, বাংলামোটরসহ প্রায় ৪০টি সিগন্যাল পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে- কোথাও জ্বলে না লাল-সবুজ বাতি। হাইকোর্ট-প্রেস ক্লাবসংলগ্ন কদম ফোয়ারা এবং কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ইন্টারসেকশনও অচল।
পুলিশ ভবন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং হোটেল সোনারগাঁও মোড়ে দাঁড়ালেই দেখা যায় ট্রাফিক সিগন্যালের দুরবস্থা।
বিজয় সরণি থেকে চন্দ্রিমা উদ্যান, আগারগাঁও থেকে মিরপুর মাজার রোড-কোনো মোড়েই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই। ধানমন্ডি ২৭, ঐতিহ্য আর সংগ্রাম ঘেরা স্থান, এখানকার সিগন্যাল পয়েন্টটিও অচল।
মিরপুর ১০ নম্বর থেকে মিরপুর থানা, প্রশিকা বিল্ডিং কিংবা ঢাকা ডেন্টাল কলেজ-সব মোড়েই দাঁড়িয়ে আছে অচল সিগন্যাল পোস্ট। বনানী ২৭ থেকে আড়ং ক্রসিং, আমতলী থেকে মহাখালী-সবকটি পয়েন্ট নষ্ট। হাউজ বিল্ডিং থেকে আব্দুলাহপুর কোনো পয়েন্টই চলে না।
শহিদ জাহাঙ্গীরগেট ইন্টারসেকশনটি সচল থাকলেও ব্যবহƒত হচ্ছে না। হাতের ইশারায় চলছে এটি। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ইন্টারসেকশন কার্যত অচল। লাল-সবুজ একসঙ্গে জ্বলে। লাভ রোড থেকে আসাদগেট সব পয়েন্ট অচল। জাতীয় সংসদ ভবন ইন্টারসেকশন, গণভবন ইন্টারসেকশন দুটিও অচল। এদিকে মেট্রোরেলের কাজে অচল ১৬টি সিগন্যাল পয়েন্ট অপসারিত করা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল) দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব খাদেম এনবি নিউজকে জানান, সিগন্যাল পয়েন্টগুলো এখন অচলাবস্থায় আছে। সিগন্যালগুলো ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রণে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। তাছাড়া এসব সিগন্যাল পয়েন্টকে কেন্দ্র করে পুলিশ বক্স-টয়লেট তৈরির আবেদন আসছে কিন্তু এসব সচল না থাকায় কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া যাচ্ছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল) সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম এনবি নিউজকে জানান, উত্তর সিটির সবকটি সিগন্যাল নষ্ট। গত ৩-৪ মাস আগে ১৭টি পয়েন্ট সচল করেছিলাম। কিন্তু, কাজে আসেনি। কিছুদিনের মধ্যেই অচল হয়ে পড়েছে। প্রকল্প পরিচালক সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, ২০১৯ সালের মার্চ থেকে সব পয়েন্ট অচলাবস্থায় আছে।
বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও মার্চে মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে আর রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক এনবি নিউজকে জানান, বাঁশের কঞ্চি আর বাঁশি দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা দেশের জন্য খুবই লজ্জার। মনে রাখতে হবে- এমন কাজের জন্য সাধারণ মানুষ, পথচারী এবং যান চালকরা আইন লঙ্ঘনে উৎসাহী হন।