এনবি নিউজঃ আইনি ব্যবস্থা বা সমঝোতার মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে ২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা আদায়ের সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকার শ্রেণিকৃত ঋণ বৃদ্ধির কারণ চিহ্নিত করতে বলা হয়। এসব ঋণ আদায়ের জন্য গ্রহণ করতে বলা হয়েছে কর্ম–পরিকল্পনা। এছাড়া আর্থিক অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিতসহ ২৯ দফা সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতি বন্ধ ও সার্বিক অবস্থা উন্নয়নে করা হয় এসব সুপারিশ। সম্প্রতি তা প্রতিবেদন আকারে পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
২০১৯ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের আর্থিক কর্মকাণ্ডের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই ব্যাংকের ৭২টি শাখার ওপর সব ধরনের সূচক বিশ্লেষণ করে এটি তৈরি করা হয়। যার ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব সুপারিশ করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালের হিসাবে বেসিক ব্যাংকে ঋণ ছিল ১৩ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। নানা কারণে এ ব্যাংকের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২৭ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বাণিজ্যিক ব্যাংক) অরজিৎ চৌধুরী বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের ফলোআপ করা হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ত্রৈমাসিক বৈঠক করে থাকে। সেখানে এ রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের পরিদর্শন প্রতিবেদন করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করে। সেখানে নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু পরিদর্শন রিপোর্ট দিলে হবে না। এর আলোকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব অনিয়মের পেছনে যদি পরিচালনা পর্ষদের কেউ জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এসব রিপোর্ট দিয়ে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না।
প্রতিবেদনে অন্যান্য সুপারিশে বলা হয়, ব্যাংকের অভ্যন্তরে সংঘটিত আর্থিক অনিয়মের বিষয়গুলো পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক থেকে তদারকি জোরদার করতে হবে। খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ পরিপালন এবং খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের হিসাব ত্রৈমাসিক অন্তর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে হবে। পাশাপাশি বেসিক ব্যাংকের সক্ষমতা অর্জনে ইতঃপূর্বে নেয়া স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া দায় ও সম্পদের সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করতে কর্ম–পরিকল্পনা, পুনঃতফসিলি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণের কথা বলা হয়।
অন্য সুপারিশগুলো হচ্ছে– গুটি কয়েক গ্রাহকের মধ্যে ঋণ বিতরণ না রেখে ঝুঁকি নিরসনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে হবে। একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বড় অঙ্কের আমানত সংগ্রহের বিপরীতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সংগ্রহকে দিতে হবে অধিক গুরুত্ব। নন–আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা এ ব্যাংকের টাকা আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। সেখানে আরও বলা হয়, ব্যাংকের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আইনজীবী নিয়োগ, সার্বিক ঝুঁকি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পালন, নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ বাড়ানো এবং ঝুঁকির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রতি বছর সংশ্লিষ্ট নীতিগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। অভ্যন্তরীণ ও বহিঃনিরীক্ষা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের সুপারিশ পরিপালনের জন্য পর্ষদ সভায় পর্যালোচনা করতে হবে। জামান–বেসিক ব্যাংক টাওয়ার বুঝে নিতে এবং কোর ব্যাংকিং সলিউশন (আইসিসিডি) বাস্তবায়নে গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থ। এর আগে বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের এ অর্থ বের করে নেয়া হয়। এর মধ্যে ভুয়া জামানতের বিপরীতে ঋণ দেয়া হয় ৪২৯ কোটি টাকা, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বের করা হয় ১৬ কোটি টাকার, জামানতবিহীন ও কম জামানত দিয়ে ঋণের নামে হাতিয়ে নেয়া হয় ৬৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া কমিটির নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঋণ দেয়া হয় ২১ কোটি টাকা ও বিধি খাতে ঋণ দেয়া হয় ৫৮ কোটি টাকা। এ নিয়ে অডিট রিপোর্টও রয়েছে।
নতুন করে আবারও বেসিক ব্যাংকের কার্যক্রম পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরা হয় ওই পরিদর্শন রিপোর্টে। সেখানে সুপারিশ ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে বলা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ঝুঁকি কমাতে এ সংক্রান্ত নীতিমালা গ্রহণের নির্দেশ থাকলেও তা কার্যকর নয়। এক্ষেত্রে একটি কার্যকরী ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইড লাইন ইস্যু করেছে। এরপর এক যুগ কেটে গেছে। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রেটিং এখনও ফেয়ার বা মার্জিনাল। বিগত পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হলেও পরিস্থিতি তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বলা হয়, কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কোনো সার্ভিস স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়ন করা হয়নি। এছাড়া ব্যাংকের সব শাখায় অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। ব্যাংক পরিদর্শন প্রতিবেদনে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে যুক্তিসঙ্গত ও হালনাগাদ জবাব দেয়া হয় না। পাশাপাশি একই জবাবের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে পরিপালন জবাব পাঠানো হয়। এছাড়া ব্যাংকের অডিট, মনিটরিং ও কমপ্লায়েন্স ডিভিশনের দুর্বলতাও পাওয়া গেছে।