সরকারদলীয় পদ–পদবি ব্যবহার করে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন পাবনা জেলা সদরের ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতারা। যাদের কয়েকজনকে এসব অপকর্মের গডফাদার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খোদ গোয়েন্দা সংস্থার গোপনীয় প্রতিবেদনে এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। তবে বছরের পর বছর এভাবে গোপনীয় প্রতিবেদন জমা দিলেও সবাই আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মূলত জড়িতরা সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যরা। একরকম অসহায়ত্ব প্রকাশের মন্তব্য করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্সের ক্ষমতা অপব্যবহারের বিষয়েও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিস্তর তথ্য দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যা আছে : পাবনা সদর থানা এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদারদের নামের তালিকায় আছেন জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেনের নাম। তিনি আপন ছোট ভাই জামিল হোসেনের মাধ্যমে মাদক সিন্ডিকেটসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। জামিলকে পাবনার অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদার বলা হয়েছে তালিকায়।
পাবনা পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুর রহমান শহীদের বিরুদ্ধেও মাদকের ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই নেতা পাবনা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের আশপাশ এলাকার মাদক ও সন্ত্রাসী সিন্ডিকেটের মূলহোতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন তিনি।
আব্দুল্লাহ আল মামুন। সবাই তাকে চিনেন নুরপুর মামুন হিসাবে। তিনি কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয় দিয়ে থাকেন। এই রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে মাদকের পাশাপাশি অস্ত্র চোরাচালান সিন্ডিকেটের গডফাদার তিনি। তার নিজস্ব অস্ত্রধারী বাহিনী রয়েছে। এই অস্ত্রধারী বাহিনী দিয়ে টার্মিনাল, মেরিল, সিংগার, নুরপুর, গাছপাড়াসহ শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম রয়েছে। সাবেক যুবলীগ নেতা নাজিমুদ্দিন গামা। তিনি সরাসরি মাদক ব্যবসা করেন না। তবে পাবনা বড়বাজার, কালাচাঁদপাড়া, দিলালপুর, পাথরতলা, শিবরামপুর, দক্ষিণ রাঘবপুর, মুজাহিদ ক্লাবসহ আশপাশ এলাকার কিছু মাদক ব্যবসায়ী অবৈধ অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার বিবরণীও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্স বলেন, ‘গোয়েন্দাদের পাঠানো কিছু তথ্য সত্য। রাজনৈতিক কারণেই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।’ অভিযোগ আছে, আপনি ব্যক্তিস্বার্থে এসব বিতর্কিত লোকদের সঙ্গে রেখেছেন–প্রশ্ন করা হলে প্রিন্স বলেন, ‘এখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই। আমি তাদের ডেকে অনেকবার সতর্ক করেছি। আর রাজনৈতিক কারণেই তাদেরকে সঙ্গে রাখতে হয়। আমাকে রাজনীতি করতে হয়।’ আপনার সুপারিশ ছাড়া কি তারা দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আমি সুপারিশ করেছি; কিন্তু পদ অনুমোদন তো দিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি।’
এমন তালিকা হওয়ার পরও মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী গডফাদারদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না–জানতে চাইলে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মো. আব্দুল বাতেন বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান হচ্ছে। জড়িত হিসাবে প্রভাবশালী অনেকের নাম–ঠিকানা গোপন প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলেও প্রমাণের অভাবে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না।’
তিনি বলেন, ‘প্রমাণসহ হাতেনাতে গ্রেফতারের অপেক্ষায় আছি আমরা। যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। মাদক সংশ্লিষ্টতা পেলে যেখানে পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করা হয়, সেখানে আর কোন প্রভাবশালী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন? সময় হলেই সব দেখতে পাবেন।’
এমপির সাতকাহন : একাধিক গোপন প্রতিবেদনে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে পাবনা–৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্সের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে তার বিষয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এ বিষয়ে বলা হয়, ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসনে কিছু নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। জেলায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কিছু নিয়োগে এমপি গোলাম ফারুক প্রিন্স তার মনোনীত লোকজনকে অবৈধভাবে চূড়ান্ত মনোনীত না করায় ক্ষুব্ধ হন। তিনি নিজেসহ তার অনুসারী দলীয় নেতাকর্মী নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষা কেন্দ্রস্থল পাবনা জিলা স্কুলে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। এ সময় পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ কর্মকর্তাদের মারধর করা হয়। ওই ঘটনায় একাধিক মামলা হয়। এই মামলা গ্রহণকে কেন্দ্র করে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও এসপির বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচি এবং সেখানে উত্তেজনাকর বক্তব্য দেওয়া হয়। পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ডিসি ও এডিসির কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর ডিসি এবং পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উত্তপ্ত এমন পরিস্থিতিতে ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পাবনায় আসেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। মূলত ২০১০ সালে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে এলাকায় দলীয় আধিপত্য বিস্তারের সূচনা হয়।
২০১৭ সালে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার আরেকটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলা হয়, ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি পাবনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন পিঙ্কবেরি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে যান একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ সময় আকস্মিক সেখানে উপস্থিত হন এমপি প্রিন্স ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ধনকুবের মো. মোশারফ হোসেনসহ তার অনুসারী নেতাকর্মীরা। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নাজেহাল করা হয়। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরাও নাজেহাল হন। কিন্তু উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামাল দিতে ডিসিকে শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়।
প্রসঙ্গত, পিঙ্কবেরি রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন ছিল শেখ রাসেল পার্ক। কিন্তু টিনশেড দিয়ে এই রেস্টুরেন্টের পরিধি বেআইনিভাবে বাড়ানোয় শেখ রাসেল পার্কের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল। এছাড়া ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এলজিইডি পাবনার উদ্যোগে নেওয়া সরকারি উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজ এমপি প্রিন্সের মনোনীত লোকদের না দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ভাঙচুর এবং কয়েকজনকে মারধর করা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এমপি গোলাম ফারুক প্রিন্সের সমর্থন ও পরোক্ষ নির্দেশে এ ঘটনা ঘটে।’ ওই ঘটনায় পাবনা সদর থানায় মামলাও হয়। এরকম অসংখ্য ঘটনার বিবরণ রয়েছে গোয়েন্দাদের নিয়মিত প্রতিবেদনে।
টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ : এমপি প্রিন্সের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শরীফ উদ্দিন প্রধান। গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে তার বিষয়ে বলা হয়, ‘এমপির ঘনিষ্ঠ হিসাবে তিনি এলাকায় বহুবার শোডাউন করেন। এছাড়া জেলার সব ধরনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই শরীফ প্রধানই ২০১৯ সালের ১৯ এপ্রিল পাবনার হামিদ রোডের মুক্তিযোদ্ধা শাহ মোতাহার হোসেনের বিধবা স্ত্রী নুরুন্নাহার বেগমের বাড়ি দখলে নেতৃত্ব দেন। এই অভিযোগে ওই বছর ১৯ ডিসেম্বর পাবনা সদর থানায় দায়েরকৃত মামলায় তাকে ৩নং আসামি করা হয়। মামলায় প্রধান আসামি হলেন কৃষ্ণপুরের শাকিল আহমেদ পায়েল। তার বিরুদ্ধে জাল দলিল সৃষ্টি করে নুরুন্নাহার বেগমের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়িটি দখলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। শরীফ প্রধান জেলার তৎকালীন পুলিশের সহযোগিতায় সশস্ত্র ক্যাডারদের নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে বাড়িটি দখল করে নেন। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা নেয় তার সশস্ত্র ক্যাডাররা। এ সময় নুরুন্নাহারসহ তার দুই ছেলেকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে টেনেহিঁচড়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় শরীফ প্রধানের লোকজন। বাড়ি দখল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে ভিন্ন এলাকায় চারদিন আটকে রাখা হয়। এ সংক্রান্ত মামলায় আরও যারা আসামি, তারা সবাই এলাকায় এমপির ঘনিষ্ঠ লোকজন হিসাবে পরিচিত। এরা হলেন এমপি গোলাম ফারুক প্রিন্সের পিএস মাসুদ (ভিপি মাসুদ), তার বিশেষ ক্যাডার হিসাবে পরিচিত হাজী ফারুক, পাবনা পৌরসভার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার রাজ্জাক, ইয়াবা ব্যবসায়ী কিরণ, স্থানীয়ভাবে বিতর্কিত কুদরত, টিটু, ভাগনে ফারুক, মুখ পোড়া রাজু, রনো, কিরন ও পাগলা সোহান।
নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত কিছু অভিযোগের বিষয়ে সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স বলেন, ‘আমি ঠিকাদারি করি। কিন্তু ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করার যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। আমার ঠিকাদারি অন্য জায়গায়।’ ২০১০ সালে জেলা প্রশাসনে নিয়োগ নিয়ে জেলার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির বিষয়টি শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত জানত। বিষয়টি মীমাংসিত। আর ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আমি বলেছিলাম এক মাস সময় দিতে, কিন্তু দেয়নি। এ কারণে ওই অভিযান আর করতেই দিইনি। এটা আমার দোষ হলে কিছুই করার ছিল না।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : পাবনার কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী জামিল হোসেন কিছুদিন ধরে পলাতক আছেন। চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে তার ভাই জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেন বলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ফায়দা হাসিল করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব অভিযোগ করছেন। আমার ভাই জামিল হোসেনকে মাদক খাওয়া শিখিয়েছে একটি প্রভাবশালী পরিবার। তার বিরুদ্ধে মামলাও একই ষড়যন্ত্রের অংশ।
নাজিমুদ্দিন গামা নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সঠিক নয়। সবই ভিত্তিহীন।
পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুর রহমান শহীদ বলেন, টার্মিনালের পাশে বাড়ি–এটাই আমার অপরাধ। আসলে পাঁচ বছর ধরে আমি বদলে গেছি। মিথ্যা কথাও বলি না। তবে ঘটনা মনে আছে, তা হলো : ২০১২ সালের ট্রাক টার্মিনোলের পাশে জঙ্গল ছিল। ওই সময় সেখানে মাদক বিক্রি হতো। আমাদের দলীয় কিছু ছেলে সেখান থেকে মাদক কিনত। তখন খবর পেয়ে আমি বন্ধ করে দিই। আমি মাদকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি।
কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কয়েকদিন ধরে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।